
প্রায় ৬০০ বছর ধরে এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে অটোমান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্য। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপের হাঙ্গেরি, রাশিয়ার ক্রিমিয়া থেকে পূর্বে জর্জিয়া এবং আরবের ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্য। অটোমান সাম্রাজ্যের দাসি বা যুদ্ধবন্দী নারীদের অন্দরমহলকে বলা হতো হেরেম। যে নারীরা সাম্রাজ্যের হেরেমে থাকতে তারা সুলতানের সম্পত্তিতে পরিণত হতো, যার সাথে সুলতান যৌন মিলনের অধিকার রাখতেন। খবর বিবিসির।
শত শত বছর ধরে অটোমান সাম্রাজ্য বংশ পরম্পরা টিকিয়ে রাখতে হেরেমে থাকা এই সব নারীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কারণ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার সুলেমানদের বেশিরভাগই এই নারীদের গর্ভে জন্ম নেয়া। ওই সুলেমানরা তাদের বৈধ স্ত্রীর চেয়ে হেরেমে থাকা নারীদের গর্ভেই সন্তান জন্ম দিতে পছন্দ করত।
চীন পারস্য, মিশর, ভারত এবং পরে মুসলিমদের ভিতর যত হেরেমে পাওয়া গেছে, তার ভিতর অটোমানের সুলতান সুলেমানের হেরেম সবচেয়ে বিখ্যাত। সম্ভবত তার বিশাল বড় রাজপ্রসাদের কারণে। অথচ সুলেমানের হেরেম নিয়ে বিস্তারিত তথ্য কম পাওয়া যায়। কারণ বাহিরে হেরেম নিয়ে আলোচনা ছিল নিষিদ্ধ।

আফ্রিকার সুদান, ইউরোপ, ইউক্রেন, রাশিয়া, সিরিয়া, বাগদাদ, মিশর, সব স্থান থেকেই ক্রয় করা দাসি আসত। সুদানি দাসিদের মূলত চাকর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সার্রশানীয় রাশিয়ান মেয়েদের মূল্য বেশি ছিল। সে সময়ে খ্রিস্টান এলাকায় অটোমান সুলতানদের বহু উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়েছিল, গনিমতের প্রচুর দাসিও আসত। সুলতানদের খ্রিস্টান নারীদের ভোগ করার আলাদা আগ্রহ কথা জানা যায়। সম্ভবত খ্রিস্টান নারীরা শিক্ষিত ছিল বলে।
অটোমান সাম্রাজ্যের হেরেমগুলোর একটি ক্ষেত্রে ধন্যবাদ প্রাপ্য কারণ তারা, ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী কিছু নারী চরিত্রকে সামনে আনতে পেরেছে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অ্যালেন মিখাইলের মতে, অটোমান ইতিহাসের ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, প্রায় সমস্ত সুলতানের মায়েরা আপাতদৃষ্টিতে ক্রীতদাস ছিলেন। বিশ্বের অন্যতম বড় এই সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার ধারা টিকিয়ে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আর এক্ষেত্রে নারীদের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়।
তুরস্কের মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এব্রো বোয়ার তার ‘অটোমান উইমেন ইন পাবলিক স্পেস’ বইতে লিখেছেন, এই নারীদের মধ্যে অনেকেই শুধু হেরেমের মধ্যে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেননি। তারা শুধুমাত্র সুলতানদের যৌন দাসী এবং তাদের সন্তান জন্মদানকারী নারী হওয়ার ভূমিকায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। হেরেমের অনেক নারীই এই প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। তারা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাদেরকে বিভিন্ন স্তরে এবং বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা গেছে। অটোমান সাম্রাজ্যের অনেক যুবরাজ এবং সুলতান প্রেম করে বিয়ে করেছেন, আবার অনেক বৈবাহিক সম্পর্ক রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণেও হয়েছিল। যেমন, অটোমান শাসকরাও রাজনৈতিক জোট প্রতিষ্ঠা বা শক্তিশালী করার জন্য এই অঞ্চলের অন্যান্য নেতাদের কন্যাদের বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সুলতানদের এই সাধারণ প্রবণতায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়।

অধ্যাপক অ্যালেন মিখাইলের মতে, “সুলতানরা চাইতেন যে তাদের সন্তান, রাজকুমার এবং ভবিষ্যৎ সুলতানরা যেন তাদের স্ত্রীর চেয়ে তাদের উপপত্নীর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে,”। অন্য কথায়, তারা সন্তান ধারণের জন্য হেরেম থেকে একজন নারীকে বেছে নিতেন”।
অধ্যাপক বোয়ার বলেন, “স্বাধীন নারী যারা একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল, তাদের এভাবে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুলতানরা তাদের উত্তরাধিকার ধরে রাখতে বা তাদের সন্তানের মা হিসেবে রাজনৈতিক সম্পর্কহীন নারীদের বেছে নিতে শুরু করেন। ওই সময়ে, সুলতানের সন্তানদের একজন যদি তার স্ত্রীর গর্ভে এবং অন্যজন উপপত্নীর গর্ভে জন্ম নেয়, তবে উভয়েরই সিংহাসনে বসার সমান অধিকার ছিল। শাসকরা এসব রক্ষিতাদের বিয়ে করার চিন্তা না করেই সন্তান জন্ম দিতেন। অটোমান শাসকদের বিজয়ের ফলে অনেক নারীকে জোরপূর্বক সাম্রাজ্যের রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল”।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অ্যালেন মিখাইল বলেছেন, যদি আমরা সাম্রাজ্যের প্রাচীন সময়ের কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে এই নারীদের মধ্যে অনেকেই দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে এসেছিলেন, অর্থাৎ বর্তমান রোমানিয়া এবং ইউক্রেন থেকে। সেইসাথে দক্ষিণ রাশিয়া, কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল এবং ককেশাস থেকে। একবার এই নারীরা সাম্রাজ্যের হেরেমে প্রবেশ করলে, তারা সুলতানের সম্পত্তিতে পরিণত হন, যার সাথে সুলতান যৌন মিলনের অধিকার রাখেন।
তবে অধ্যাপক বোয়ারের মতে যে বিষয়টি একজন সাধারণ উপপত্নীকে শক্তিশালী করে তুলেছিল সেটি হল, সুলতানের সন্তান জন্ম দেয়া, বিশেষত যদি একটি ছেলে সন্তান হয়। ওই সময়ে অনেক শিশু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে অল্প বয়সেই মারা যেতো এবং এ কারণে ওই যুগে বেশি সংখ্যাক পুরুষ উত্তরাধিকারী জন্ম দেয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হতো।
মিখাইল বলেন, “বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো, একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরে একজন রাজপুত্রকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হতো, যেখানে তার মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল বংশের ধারা টিকিয়ে রাখা এবং সেক্ষেত্রে যদি কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকত, তবে এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। যে কারণে আরও বেশি পুরুষ সন্তান থাকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যাতে তাদের একজনের কিছু ঘটে গেলে মানে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হলে, অন্য সন্তানটি সেখানে দায়িত্ব নিতে পারে”।
অধ্যাপক মিখাইল বলেন, “হেরেমের ভেতরে মা ও ছেলে ‘একটি দলের’ মতো থাকতেন। সুলতানের উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌড়ে, মায়েরা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তারা তাদের সন্তানদের শীর্ষ পদে পৌঁছাতে সাহায্য করতেন। কোন ছেলে সন্তান তার বাবার সবচেয়ে প্রিয় হবে? সেরা শিক্ষা কে পাবে? কোন ছেলে বড় হয়ে রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবে? এভাবে শুধু উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নয়, তাদের মায়েদের মধ্যেও প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল”।

“যখন এই শিশুরা বড় হয়, ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে এলেই, তাদের নিজেদেরকে উত্তরাধিকারের যোগ্য প্রমাণ করতে হতো। তাদের বিভিন্ন পদ বা কাজ অর্পণ করা হত, যেমন উদাহরণস্বরূপ, একটি ছোট শহর শাসন করার সুযোগ দেয়া হতো। তখন এই শিশুদের সঙ্গে তাদের মায়েরা থাকতেন, সঙ্গে আরও থাকতেন উপদেষ্টাদের একটি দল। একটি ১২-১৩ বছর বয়সী কিশোর, যাকে একটি শহরের গভর্নর নিযুক্ত করা হলো, স্বাভাবিক যে সে এই ধরনের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত হবে না। তাই এটি স্পষ্ট যে এই ছোট শহরগুলোর ব্যবস্থাপনায় তাদের মায়েরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন,”- বলেন অধ্যাপক মিখাইল।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে, রাজপুত্র শহরের গভর্নর ছিলেন, কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
ইতিহাসবিদরা ওই সময়ে লেখা দলিল, আদালতের নথি এবং চিঠি থেকে জেনেছেন যে, সেসময় কিশোর গভর্নরদের মায়েরাই আসলে শহরটি পরিচালনা করতেন। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। অবশ্যই, যদি আপনার ছেলে সুলতান হয়, তাহলে পরিবারে আপনার অবস্থান বদলে যাবে। আর আপনি রাজমাতার স্বীকৃতি পাবেন এবং পরিবারের একজন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন।
সুলতানের মায়ের অবস্থান সব সময় খুব শক্তিশালী ছিল এবং অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এই মায়েরা বিভিন্ন সময়ে প্রাসাদে প্রচুর ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। ৬০০ বছরেরও বেশি সময়ের অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে, প্রায় সকল সুলতানের মায়েরাই আপাতদৃষ্টিতে ক্রীতদাস ছিলেন। যারা এ সাম্রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেননি, সম্ভবত বড় অংশই খ্রিস্টান পরিবার থেকে এসেছিলেন। যাদেরকে হেরেমে প্রবেশ করার পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল।
ইস্তাম্বুলের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হল তোপকাপি প্রাসাদ, যা প্রায় ১৪৭৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত অটোমান রাজদরবারের প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং বাসস্থান ছিল। প্রাসাদে প্রবেশ করলে দেখা যায় হেরেমটি অটোমান সাম্রাজ্যের সরকারি কার্যালয়ের ঠিক পাশেই অবস্থিত। হেরেমে থাকা নারীরা সে সময় সুলতানের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী, যারা সুলতানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে ছিলেন, তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। এভাবে, এই নারীরা ‘ক্ষমতার কেন্দ্রে’ থাকতেন।

অধ্যাপক মিখাইল বলেছেন যে, “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম নিবিড়ভাবে দেখার পরে, তারা নিজেরাও এতে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে সাম্রাজ্যের বাস্তবতা ছিল যে যোগ্য, সেই টিকে থাকবে। যে মা দ্রুত শিখতে পারতেন এবং তিনি তার ছেলেকে যা শেখাতে পারতেন, সেটাই বিশ্ব শাসনে কাজে লাগত”।
হেরেমটি তখন ভবিষ্যৎ সুলতানদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। প্রথম সুলতান সেলিমের জীবনী ‘গডস শ্যাডো’তে একজন গবেষক বর্ণনা করেছেন, সেলিম ১৪৭০ থেকে ১৫২০ সাল পর্যন্ত তুরস্ক শাসন করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, “হেরেম, যাকে কিংবদন্তি মর্যাদা দেওয়া হয়, সেটি একটি স্কুলের মতো ছিল, যেখানে সমস্ত বিলাসিতা রয়েছে। যা কোন একটি সাধারণ মুসলিম পরিবারের চিন্তার বাইরে ছিল”।
ওই গবেষকের মতে, সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের পর তিনজন শক্তিশালী উত্তরাধিকার ছিলেন, যারা সবাই সুলতানদের উপপত্নীদের ছেলে ছিলেন এবং সবাই হেরেমে একই ধরনের শিক্ষা লাভ করেছিলেন – ভাষা, দর্শন, ধর্ম, সামরিক শিক্ষা। তাদের মধ্যে প্রথম সেলিম প্রভাবশালী ছিলেন, যার শাসনামলে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে।
উত্তরাধিকারের দৌড়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে সৎ-ভাইরা প্রায়শই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠত, এমনকি কেউ কেউ শত্রুও হয়ে পড়তো। এর কারণ সম্ভবত তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ঘনিষ্ঠ ছিল না, যদিও তাদের বাবা একজনই, তারপরও তাদের মধ্যে সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব ছিল। এমনকি শিশু থাকা অবস্থাতেই তাদেরকে হেরেমে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো যেন তারা নিজেদেরকে সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শেখে।
কয়েক বছর পর, কিশোর বয়সে, তাদেরকে বিভিন্ন শহরে পাঠানো হতো, এতে সৎ-ভাইদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আরও কমে যেত। সুলতানের কোন ছেলে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে, তিনি শুরুতেই তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করে দিতেন বা মেরে ফেলতেন। এবং এটি বেশ সাধারণ বিষয় ছিল, বিশেষ করে সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে। যেমন, সিংহাসনে বসার পরপরই প্রথম সেলিম তার দুই সৎ ভাইকে হত্যা করেছিলেন।

অধ্যাপক মিখাইল তার বইতে ব্যাখ্যা করেছেন, সাধারণত বড় ছেলে উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসন পেতেন, তবে নিয়মানুযায়ী যে কোনও পুরুষ উত্তরাধিকারী সিংহাসনে বসার অধিকারী ছিলেন। তাই উত্তরসূরিদের অধিকাংশই ছিলেন রক্তপিপাসু।
অধ্যাপক বোয়ার বলেছেন,” প্রকৃত সত্য হলো, যে উপপত্নীরা সুলতানের পছন্দের ছিলেন তাদের সন্তানদেরই সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা দেয়া হতো। এককথায় তারা ‘সুলতানের হৃদয়ের দরজা দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারে’ পৌঁছুতে পারতেন। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত ক্রীতদাস রোকসেলিনা, যিনি সুলতান সুলেমানের প্রেম জয় করে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে মহান রাণী হিসেবে পরিচিতি দিতে পেরেছিলেন”।
অপহরণের পর তাকে দাস হিসেবে সুলেমানের হেরেমে বিক্রি করা হয়, তখন তিনি কিশোর বয়সী ছিলেন। প্রথমে তিনি সুলতানের প্রিয় দাসী হয়ে ওঠেন, তারপর তার স্ত্রী এবং তারপরে তিনি সুলতানের একাধিক সন্তানের মা হন। কিন্তু সুলতান সুলেমান, যিনি ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, তার আগে থেকেই অন্য নারীর সাথে একটি পুত্র সন্তান ছিল, যার নাম ছিল মুস্তফা। মুস্তাফা সিংহাসনের উত্তরাধিকারের জন্য শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু রোকসেলিনা নিজেই বেশ শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন এবং তিনি তার ছেলেকে পরবর্তী সুলতান বানাতে মরিয়া হয়ে পড়েন। তিনি সুলতান সুলেমানকে বোঝালেন যে মুস্তফা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছেন। রাজদ্রোহের দায়ে সুলতান তার পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং রোকসেলিনার পুত্র দ্বিতীয় সেলিম সিংহাসনে বসেন।
অধ্যাপক বোয়ার বলেছেন, “১৬০০ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ১৭০০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, প্রাসাদে এমন নারীরা ছিলেন, যারা ক্রীতদাস হিসেবে হেরেমে জীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন”।
একটি বিষয় তিনি তার লেখায় স্পষ্ট করেছেন, অটোমান সাম্রাজ্যে একজন ক্রীতদাসের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। যখন আমরা ক্রীতদাস শব্দটি শুনি, তখন আমরা ট্রান্স-আটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্যের কথা ভাবি – যেখানে আফ্রিকার মানুষদের আমেরিকা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। অটোমান সাম্রাজ্যে দাসত্ব কোনো বংশগত প্রথা ছিল না। একজন দাস স্বাধীন হতে পারেন।
তবে অবশ্যই ক্রীতদাস নারীরা মুক্ত ছিলেন না। তাদেরকে সুলতানের যৌন চাহিদা মেটাতে হতো। এছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তাদের সন্তানরা স্বাধীনভাবে চলতে পারতেন।
অধ্যাপক মিখাইল তার বইতে লিখেছেন, প্রথম সেলিমের মা গুলবাহার খাতুনের বাবা অটোমান সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু একই সাথে তিনি তার মেয়েকে উপপত্নী হিসাবে সুলতানের কাছে দেন। মূলত সামাজিক সুবিধা পাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে তিনি এই লেনদেন করেছিলেন। গুলবাহার জানতেন, তিনি তার নিজের শহরের চেয়ে প্রাসাদে আরও আরামদায়ক জীবনযাপন করতে পারবেন। তিনি একজন সুলতানের মা হওয়ার সুযোগ পাবেন এবং তাই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এমনকি বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর নারীর ভূমিকা নিতে পারবেন। তাই হয়েছিল। তিনি সরকারি কার্যক্রমেও তার প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন, অটোমান রাজার মায়েদের জন্য যা একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।
লেখা : বিবিসি অবলম্বনে