ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যু পর থেকেই সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর আগের শুরু হওয়া এ দ্বন্দ্ব এখন সমানতালে চলছে বর্তমান বিশ্বে। আরব বিশ্ব বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনীতি ঘুঁটিও চলে শিয়া ও সুন্নি মতভেদকে কেন্দ্র করে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্কের টানাপোড়েনের পেছনেও ধরা হয় এ মতভেদ। চলমান হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধেও প্রভাব রয়েছে এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের। ফিলিস্তিনের পক্ষে নৈতিক সমর্থনে এক ধরনের অবস্থান দেখা গেলেও দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব মুছে যায়নি।

শিয়া-সুন্নি বিভাজনের শুরুটা হয়েছিল ৬৩২ সালে ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর পর। সেসময় মুসলিমদের নেতৃত্ব কে দিবে সেখান থেকে সূত্রপাত হওয়া দ্বন্দ্ব এখনো বিভাজন টিকিয়ে রেখেছে।

যদিও উভয় সম্প্রদায়ই বহু শতাব্দী ধরে একসাথে বসবাস করে আসছে। দুই দিকের বিশ্বাস ও রীতিনীতিতেও অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু মতবাদ, ইবাদত, শরিয়াহ ও নেতৃত্বের ব্যাপারেও তাদের মতভেদ রয়েছে। বিশ্বজুড়ে যারা ইসলামে বিশ্বাসী তাদের অধিকাংশই সুন্নি সম্প্রদায়ের।

একটি হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম এই শাখার সাথে যুক্ত। এই পক্ষের মানুষ নিজেদেরকে ইসলামের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও রক্ষণশীল সম্প্রদায় হিসেবে দেখে।

সুন্নি শব্দটি এসেছে ‘আহল-আল-সুন্নাহ’ শব্দ থেকে। এর অর্থ যারা সুন্নাহ অনুসরণ করেন।

সুন্নাহ বলতে নবী মোহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের কর্মের উপর ভিত্তি করে যে শিক্ষা অনুশীলন করা হয় সেটাকে বোঝায়। সুন্নিরা কুরআনে বর্ণিত সব নবীদের সম্মান করে যাঁদের মধ্যে শেষ নবী ও রাসুল মোহাম্মদ (সা.) সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করেন।

a poster with a picture of a hand holding a fist
Photo by Şeyma D. on Pexels.com

সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম আলেমদের দেশের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। আর সুন্নি আলেমদের শিক্ষা সাধারণত ইসলামি আইনি ব্যবস্থার অধীনে চারটি মাজহাব থেকে এসেছে।

বিশ্বের অনেক মুসলিম প্রধান দেশ সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এর ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সৌদি আরবে।

শিয়াদের শুরুটা হয়েছিল মূলত একটা রাজনৈতিক দল ‘শিয়াত আলী’ বা ‘আলীর দল’ হিসেবে। আলী ছিলেন নবী মোহাম্মদের (সা.) জামাতা এবং একাধারে ইসলামের চার খলিফার অন্যতম। শিয়ারা দাবি করে যে শুধু আলী এবং তার বংশধরদের মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার ছিল।

খিলাফতকালে ষড়যন্ত্র, সহিংসতা এবং গৃহযুদ্ধের কারণে আলীর মৃত্যু হয়েছিল। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে আলীর মৃত্যুর পর তার পুত্র হাসান বা হোসেইনের খেলাফত পাওয়া উচিত ছিল যেটা হয়নি।

ধারণা করা হয়, হাসানকে উমাইয়া রাজবংশের মুসলিম নেতা মুয়াবিয়া বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। আর তার ভাই হোসেইন পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ কারবালার যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান। এই ঘটনাগুলো শিয়াদের মধ্যে শাহাদাত ও শোক পালনের ধারণার জন্ম দেয়।

city man people woman
Photo by Musa Zanoun on Pexels.com

শিয়াদের মধ্যেও আলেমদের শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। এই আলেমরা ইসলামি গ্রন্থের ব্যাখ্যার অনুশীলন করেন।

ধারণা করা হয় বর্তমানে বিশ্বে ১২ কোটি থেকে ১৭ কোটি শিয়া রয়েছে এবং প্রতি ১০ জন মুসলিমের একজন শিয়া। অর্থাৎ মোট মুসলিম জনসংখ্যার ১০ শতাংশ শিয়া। ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আজারবাইজানে এবং কিছু অনুমান অনুযায়ী ইয়েমেনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে আফগানিস্তান, ভারত, কুয়েত, লেবানন, পাকিস্তান, কাতার, সিরিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আমিরাতেও শিয়াদের উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা রয়েছে।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
শিয়ারা সাধারণত সুন্নি শাসিত দেশগুলিতে সবচেয়ে দরিদ্র গোষ্ঠী। শিয়ারা নিজেদেরকে নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হিসেবে দেখে। সুন্নি চরমপন্থিদের কেউ কেউ শিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের প্রচারও করে।

যেমন পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে প্রায়ই শিয়া উপাসনালয়ে আক্রমণের ঘটনা দেখা যায়। উভয়ের মধ্যে এই বিভাজন অনেক সময়ই মধ্যপ্রাচ্যে কারা জোট হিসেবে থাকবে বা কাদেরকে শত্রু হিসেবে দেখা হবে সেটা নির্ধারণ করে।

১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব এই অঞ্চলে একটি শিয়া মৌলবাদী ইসলামি অ্যাজেন্ডা চালু করেছিল। উপসাগরীয় দেশগুলোর সুন্নি সরকারের জন্য এটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ।

বিপ্লবের পর ইরান নীতি গ্রহণ করে দেশের বাইরের শিয়া ও মিলিশিয়াদেরও সাহায্য করার। এটি মোকাবেলায় সুন্নি দেশগুলোও বিভিন্ন আন্দোলনে সমর্থন দিতে শুরু করে। ১৯৭৯ এ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পর ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ার শিয়াদের সমর্থন দিতে থাকে ইরান।

white concrete building
Photo by Haley Black on Pexels.com

উদাহরণস্বরূপ লেবাননের গৃহযুদ্ধে ইরান-সমর্থিত হেজবুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সুন্নি দল তালেবানকে দেখা হয় অনেকটা চরমপন্থি হিসেবে যারা প্রায়শই শিয়াদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালায়।

ইরাক এবং সিরিয়ার সাম্প্রতিক সংকটেও দুই গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নজির দেখা যায়। এসব দেশে অনেক তরুণ সুন্নি অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের মাঝে সুন্নি গোষ্ঠী আল-কায়েদার চরমপন্থি মতাদর্শ প্রভাব বিস্তার করে।

সিরিয়ার শিয়া দলগুলো দেশটির সরকারের পাশে থেকে বাশার আল আসাদের সমর্থনে লড়াই করছে এবং তার প্রশাসনকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছে। তবে ইরান ও সৌদি আরব উভয়েই সুন্নি মতাদর্শ ইসলামিক স্টেটকে তাদের অভিন্ন শত্রু মনে করে।

সুন্নি হামাসের সমর্থনে শিয়া ইরান
গত কয়েক দশক ধরে ইরান ও সৌদি আরবের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে যার পেছনে ধর্মীয় বিভাজনও একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাতেও তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পেছনে ইরান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা ভেস্তে দেয়া।

কারণ এটা ঘটলে ইরানের প্রধান তিন শত্রু- ইসরাইল, সৌদি আরব ও আমেরিকার মধ্যে একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এমন চুক্তির পরিবেশ তৈরিতে আমেরিকা ভূমিকা রেখেছে।

হামাস একটি সুন্নি গোষ্ঠী হলেও কয়েক দশক ধরে ইরানের মিত্র। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হামাসকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেয় ইরান।

আবার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য গোষ্ঠী যারা হামাসকে সমর্থন করেছে এবং এই যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে তারা হল লেবাননের হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। তারা উভয়ই শিয়া গোষ্ঠী যারা তেহরানের মিত্র।

সেদিনের হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনে ক্রমাগত হামলা শুরু করে ইসরায়েল; এ প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব-ইসরায়েল চুক্তির বিষয়টি থেমে যায়। সৌদি আরবের রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল সাধারণ মানুষের ক্ষতি করার জন্য ইসরাইল ও হামাসের সমালোচনা করেছেন।

যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি সৌদি আরব সরকার।

লেখা : বিবিসি অবলম্বনে

Muktojanala

সমসাময়িক সকল বিষয়ের মুক্ত তথ্যের অনলাইন প্লাটফর্ম।

https://www.muktojanala.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *