রাজধানীর মানুষও চড়ছে স্বপ্নের মেট্রোরেলে। শুরুতে কিছুটা সীমিত গতি নিয়ে এই গণপরিবহন চালু হলেও আগামী মার্চে চলবে ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার বেগের পূর্ণগতি নিয়ে। আর এই স্বপ্নযাত্রার নেপথ্যে আছে দশ বছরের দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী-কর্মীর ঘামঝরা কর্মঘণ্টার হিসেব।

কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা পথের পাঁচালীতে কাশবনের ফাঁক গলে কু ঝিক ঝিক করতে করতে এগিয়ে চলা স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল অপু-দুর্গা।

স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেন তামাদি হয়ে গেছে সেই কবে। এখন ডিজেল-ফার্নেস অয়েলের ইঞ্জিনের চাইতে বিদ্যুচ্চালিত ট্রেনে গতি- আয়েশ–দুইই বেশি। যানজটকে তুড়ি মেরে হটিয়ে দিয়ে দূরের প্রান্তেও ঠিক সময়ে যাত্রী পৌঁছে দেয়ার ভরসায় গোটা দুনিয়ায় এখন তুমুল জনপ্রিয় মেট্রোরেল।

আর এই মেট্রোরেলের চড়ার মজা পেতে এতদিন বিদেশ-বিভূঁইয়ে যেতে হতো। নয়তো দেখতে হতো টিভি পর্দায়।এবার তা পায়ের গোড়ায়। দিনের সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে এই ট্রেন, বাকি সময় থাকবে বন্ধ। তবে পুরোদিন বন্ধ থাকবে সাপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার।

এই শুরুতে ট্রেন চলবে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও রুটে, ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে পাড়ি দেবে পৌনে ১২ কিলোমিটার পথ। মাঝের কোনো স্টেশনে আপাতত থামবে না। গতিও থাকবে অর্ধেকে সীমিত। মার্চে গতি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। তখন মাঝের সব স্টেশনে উঠানামার সুযোগ পাবেন যাত্রীরা।

ধনীদেশের মেট্রো রেলে যা আছে তার সবই থাকবে ঢাকার ট্রেনেও। প্রতি সেট ট্রেনে বগি থাকবে ছয়টি, বডি স্টেইনলেস স্টিলের। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রতি বগির দুইপাশে আছে চারটি করে দরজা। ট্রেন স্টেশনে এলে দুদিকের সব দরজা খুলে যাবে সময়ধরে।

নির্ধারিত সময় পার হলে মধুরঘন্টা বাজিয়ে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে স্বযংক্রিয়ভাবে। এরমধ্যে সারিবেধে চলবে যাত্রী ওঠানামা।প্রতিটি ট্রেন ১ হাজার ৭৩৮ যাত্রী নিয়ে যাবে পরের গন্তব্যে। পুরোমাত্রায় চালু হলে যাত্রী পরিবহন হবে ঘন্টায় ৬০ হাজার।

মেট্রোরেলে চড়তে হলে কিনতে হবে প্লাস্টিকে তৈরি স্মার্ট কার্ডের টিকেট। মিলবে সহজে। রেলস্টশনের মেশিন থেকে কেনা টিকেট, রিচার্জ করাও যাবে নির্ধারিত বুথ থেকে। প্রতিবার যাওয়া-আসায় টিকেটের টাকা কমতে থাকবে দূরত্ব অনুপাতে। সাপ্তাহিক-মাসিক টিকেটও কাটা যাবে। তবে স্থায়ী টিকেট কাটার জন্য যাত্রীকে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে আগেভাগে।

জাপানের কারখানায় তৈরি মেট্রোরেলের ইঞ্জিন-বগি ঢাকায় আসার পর উত্তরায় ডিপোতে চলে ১৯ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রথমে ডিপোর ভেতর ট্রায়াল ট্র্যাকে চালানো হয় মেট্রোরেল। পরে মাসখানেক ধরে চলে ট্রেনের পরীক্ষামূলক চলাচল।

মেট্রোরেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। চালুর আগেই উত্তরা ও আগারগাঁও এলাকায় মেট্রোকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

এসব এলাকায় বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস, খাবারের দোকান, সিনেমা, শপিং মল, আবাসন প্রকল্প ইত্যাদি রমরমা হতে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, পুরোদমে মেট্রোরেল চালু হলে সংলগ্ন এলাকায় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাড়বে আশাতীত হারে।

২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হলেও বাসতবায়ন শুরু ২০১৬ তে। প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ব্যয়ের এক প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

ভুলে গেল চলবে না, নিয়ম ভাঙলেই ভুগতে হবে, মেট্রোরেল যাত্রীদের। কম দূরত্বের টিকিট কেটে বেশি দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার অসৎ ভাবনা তো না ভাবাই ভালো।

টিকিটে নির্ধারিত দূরত্বের চেয়ে বেশি পথ গেলে যাত্রীকে জরিমানা দিতে হবে ভাড়ার ১০ গুণ পর্যন্ত , নয়তো টানতে হবে জেলের ঘানি। কম টাকায় কেউ দূরের পথে যাবার চেষ্টা করলে আটকা পড়বেন স্টেশনে, পথ পাওয়া যাবে না বের হবার। কাজেই সাধু সাবধান।

জেনে নিন কীভাবে চড়বেন ঢাকার মেট্রোরেলে

উত্তরার উত্তর স্টেশন হবে মেট্রোরেলের প্রারম্ভিক স্টেশন। তিনতলা স্টেশন ভবনের উপরের তলার প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে চড়বেন যাত্রীরা।

ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে পৌঁছে এস্কেলেটর বা সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলার কনকোর্স হলে উঠতে হবে যাত্রীদের।

বয়স্ক ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন নাগরিকদের জন্য স্টেশনে রয়েছে লিফটের ব্যবস্থা।

টিকেট ছাড়া কেউ প্ল্যাটফর্মে যেতে পারবেন না। ট্রেনে উঠতে যাত্রীদের দোতলার কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে।

প্ল্যাটফর্মে ওঠার প্রবেশপথে নির্ধারিত জায়গায় টিকিট পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে যাত্রীদের। টিকিট পাঞ্চ করার পর দোতলা থেকে নির্ধারিত এস্কেলেটর বা সিঁড়ি কিংবা লিফট ব্যবহার করে প্ল্যাটফর্মে উঠবেন যাত্রীরা।

উত্তরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম তৃতীয় তলায়। যেখানে ট্রেন থামবে সেখানেই ওঠা-নামা করবেন যাত্রীরা।

প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামার সাথে সাথে খুলে যাবে সংক্রিয় দরজা। যাত্রী উঠা-নামা শেষে আবার নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে।

কেউ যদি অতিরিক্ত পথ ভ্রমণ বা কোনোভাবে টিকেট ছাড়া ট্রেন ভ্রমণ করেন তখন প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হওয়ার সময় টিকেট দেখাতে না পারলে আর নিচে নামতে পারবেন না। পরে বাড়তি ভাড়া আদায় করে তাকে যেতে দেওয়া হবে।

Muktojanala

সমসাময়িক সকল বিষয়ের মুক্ত তথ্যের অনলাইন প্লাটফর্ম।

https://www.muktojanala.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *