কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে অনেক দিন ধরেই নানা রকম আশা-নিরাশার গুঞ্জন চলছে। অনেকে অনেক ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন এটি নিয়ে। এবার এই গুঞ্জনের ঘি ঢাললেন খোদ ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা। তার মতে, এআই প্রায় ৪০ শতাংশ চাকরি খেয়ে ফেলবে!
সুইটজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বৈঠকে যখন বৈশ্বিক ব্যবসা ও রাজনৈতিক নেতারা একত্র হয়েছেন তখনই আইএমএফের এই বিশ্লেষণ এলো।
আইএমএফের এই প্রতিবেদনে উচ্চ বেতনের এবং উচ্চপদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে বলা হয়েছে এবং এআই-এর বৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে বিষম প্রভাব আসতে পারে।
আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘বেশির ভাগ পরিস্থিতিতে এআই সম্ভবত সামগ্রিকভাবে বৈষম্যকে আরো ভয়াবহ করবে। প্রযুক্তিকে প্রতিরোধ করতে নীতি নির্ধারকদের উচিত এই সংকটজনক প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করা।’
‘বেশির ভাগ দেশের এআই এর সুবিধা ব্যবহারের মতো অবকাঠামো বা দক্ষ জনশক্তি নেই। সময়ের সাথে সাথে জাতিগুলোর মধ্যে এই প্রযুক্তি বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলবে।’- বলেন জর্জিয়েভা।
আরো সাধারণভাবে বলা যায়, এআই প্রযুক্তি গ্রহণ করার পরে উচ্চ আয় এবং তরুণ কর্মীরা তাদের মজুরি অসমভাবে বৃদ্ধির বিষয়টি দেখতে পাবে।
আইএমএফের বিশ্বাস, নিম্ন আয় এবং বৃদ্ধ কর্মীরা পেছনে পড়ে যাবেন এআই প্রযুক্তির কারণে।
এআই-এর প্রভাব মোকাবিলায় পুনঃপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করার জন্য উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফ প্রধান। তার মতে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক কর্মী চাকরি হারাতে পারেন এআই-এর কারণে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্ববাজারে উৎপাদন বাড়বে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ভাল হবে বলেও আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি।
ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বলেন, ‘বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থায় ব়ড় রকম পরিবর্তন আসবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে, তবে মনুষ্যত্বের উপকারে এই ব্যবস্থাকে যাতে ব্যবহার করা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে মানুষকেই।’
অন্য ভাবে বলা যায়, এআই-এর সে সব কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে যা এখন মানুষ করছে। এটা শ্রমের চাহিদা কমাতে পারে, মজুরিতে প্রভাব এবং এমনকি চাকরি চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।
এই প্রতিবেদন ২০২৩ সালে গোল্ডম্যান স্যাকসের একটা প্রতিবেদনের অনুরূপ। যাতে বলা হয়েছিলে, এআই ৩০০ মিলিয়ন পূর্ণকালীন চাকরি প্রতিস্থাপন করতে পারে। কিন্তু আরো বলা হয়েছে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন চাকরিও হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে ওপেনএআই নামের একটি গবেষণা দল এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছিল, যেটি প্যারাগ্রাফের কয়েকটি মাত্র অর্থবহ টেক্সট লিখতে পারত। এছাড়া এই সফটওয়্যার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছু পড়ে মোটামুটি তা বুঝতে পারত, কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পারত।
ওপেনএআই শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের তৈরি এই সফটওয়্যার, যেটির নাম তারা দিয়েছিল জিপিটি-টু, সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করবে না। তাদের আশঙ্কা ছিল, লোকে এটি ব্যবহার করে খারাপ উদ্দেশ্য ব্যাপকহারে অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার চালাবে।
তখন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ওপেনএআই-এর গবেষক দল বলেছিল, ‘এটি খুব বেশি বিপজ্জনক।’
এরপর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। ওপেনএআই এর জিপিটি-টু সীমিত কিছু ব্যবহারকারীর মধ্যে ছাড়া হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন তারা জিপিটি-থ্রি বাজারে ছাড়ল, সেটি তাৎক্ষণিকভাবে সবার ব্যবহারের জন্যই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
সাংবাদিকরা এবং বিশেষজ্ঞরা যখন এই প্রোগ্রামিং এর চ্যাটবট-জিপিটির সক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখছিলেন, তখন তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। চ্যাটবট-জিপিটি ব্যবহার করে হাজার হাজার সংবাদ প্রতিবেদন এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট লেখা হয়েছে।
প্রয়াত কমেডিয়ান জর্জ কার্লিনের স্টাইলে এটিকে দিয়ে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি লেখানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক নিয়ে।
এটি খ্রিস্টধর্ম তত্ত্ব সম্পর্কে মতামত দিয়েছে। কবিতা লিখেছে। পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম থিওরি বুঝিয়ে দিয়েছে শিশুকে।
ওপেনএআই যখন তাদের সর্বশেষ সংস্করণ জিপিটি-ফোর চালু করে, তখন তারা বলেছিল, অপব্যবহার বন্ধের জন্য এটির ভেতরে নানা ব্যবস্থা করা আছে। প্রথম যারা এর গ্রাহক হয়েছে তাদের মধ্যে আছে মাইক্রোসফট, মার্কিন ব্যাংক মেরিল লিঞ্চ এবং আইসল্যান্ডের সরকার।
সেখানে সব চেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের নভেম্বরে তৈরি হওয়ার পর সারা বিশ্বেই এখন চ্যাটজিপিটি নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শুধু তার পরের জানুয়ারি মাসেই বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছে।
লেখা : বিবিসি, আনন্দবাজার অবলম্বনে