১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুনতে ছোট মনে হলে এই সম্পদের পরিমাণ কতখানি আন্দাজ করতে পারেন? ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ছিল ৪২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ দুই ধনী বার্নার্ড আর্নল্ট ও ইলন মাস্কের মোট সম্পদ ৪২৮ (২৩৩ + ১৯৫) বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবার হিসাবটা বুঝুন মাত্র দুজন ব্যক্তির মিলিত সম্পদ বাংলাদেশের জিডিপির চাইতে বেশি।

এ তো বাংলাদেশের তুলনা দেওয়া গেল। পানামা, উরুগুয়ে, কোস্টারিকা বা বলিভিয়ার মতো দেশের জিডিপি এদের একজনের সম্পদের চেয়েও কম।

তাহলে এদের হাতে কত সম্পদ চিন্তা করুন। গত ২ এপ্রিল প্রকাশিত ফোর্বসের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর ১৪ জন ব্যক্তি প্রত্যেকে ১০০ বিলিয়ন বা তার বেশি সম্পদের মালিক। এদের মধ্যে আবার ১০ জনই যুক্তরাষ্ট্রের।

বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ। বলা হয়ে থাকে, এই ১৪ জন শত বিলিয়নিয়ারের সম্পদ দুনিয়ার বাকি সব মানুষের সম্মিলিত সম্পদের চেয়ে বেশি।

গত বছর ফোর্বসের তালিকায়, মাত্র ছয়জন টাইকুন (অত্যন্ত ধনাঢ্য ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি) ছিলেন যারা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সম্পদ গড়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছিলেন। কিন্তু এবার এই এক্সিকিউটিভ ক্লাবে এবারে মোট ১৪ জন জায়গা করে নিয়েছেন। এই ১৪ জন হলেন শুধুমাত্র তারাই যাদের মোট সম্পদের মূল্য ডলারে অন্তত ১২ ডিজিটে ঠেকেছে।

মেক্সিকান টাইকুন কার্লোস স্লিম, দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। কিন্তু এতগুলো বছর তিনিও এই তথাকথিত ওয়ান হান্ড্রেড বিলিয়নেয়ার গ্রুপে প্রবেশ করতে পারেননি। কেননা তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র অল্পের জন্য এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছিলেন। তবে এবারে তিনি পেরেছেন।

ফোর্বসের সিনিয়র সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক চেজ পিটারসন-উইথর্ন বলেছেন, এটি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের জন্য এক আশ্চর্যজনক বছর ছিল। এমন কী অনেকে যখন আর্থিক অনিশ্চয়তার সময় পার করছে, তখনও এই অতি-ধনীরা উন্নতি করে গিয়েছেন।

ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে দুই হাজার ৭৮১ জনে দাঁড়াবে। যা আগের বছরের তুলনায় ১৪১ জন বেশি এবং ২০২১ সালের আগের রেকর্ডের চেয়ে ২৬ জন বেশি।

অভিজাতরা আগের চেয়ে বেশি ধনী হবে এবং তাদের কাছে ১৪ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ জমা হবে।

এবার আসুন দেখে নেওয়া যাক কারা এই শত বিলিয়ন ডলারের মালিক :

১৪. কার্লোস স্লিম (মেক্সিকো)

মেক্সিকান ব্যবসায়ী কার্লোস স্লিম। ছবি ক্রেডিট : উইকিমিডিয়া কমনস

মোট সম্পদ : ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

ধনীদের তালিকায় বর্তমানে ১৪তম স্থানে রয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি আমেরিকা মোভিলের মালিক মেক্সিকান এই ব্যবসায়ী। একসময় বিশ্বের শীর্ষ ধনী ছিলেন এবং এখনও ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তিনি। মেক্সিকান পেসোর মান বেড়ে যাওয়া এবং তার সমন্বিত শিল্প গ্রুপো কারসোর শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরে তার ভাগ্য বদলে যায়।

১৩. আমানসিও ওর্তেগা (স্পেন)

মোট সম্পদ : ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

১৩তম স্থানে থাকা আমানসিও ওর্তেগার গত বছর ভাগ্য বদলে গিয়েছে পোশাক কোম্পানি ইনডিটেক্সের শেয়ার ৪৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে। ইনডিটেক্স কোম্পানি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড জারার চেইন পরিচালনা করে। ওর্তেগার আবাসন সংক্রান্ত ব্যবসার হিসেবের মধ্যে লজিস্টিকস, আবাসন এবং অফিসের নানা সম্পত্তি রয়েছে। এগুলো বেশিরভাগ প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

১২. মাইকেল ব্লুমবার্গ (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদ এবং মিডিয়া কোম্পানি ব্লুমবার্গ এলপির সহ-প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ব্লুমবার্গ। ধনীদের তালিকায় জায়গা পেয়েছেন ১২তম স্থানে। বর্তমানে ব্যবসার ৮৮ শতাংশের মালিক তিনি। তিনি ১২ বছর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র ছিলেন।

১১. সের্গেই ব্রিন (রাশিয়া/ যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

অ্যালফাবেটের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বোর্ড সদস্য হলেন সের্গেই ব্রিন । ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্রিন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি ল্যারি পেজের সঙ্গে কোম্পানির সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে রয়ে গেছেন।

১০. ল্যারি পেজ (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বোর্ড সদস্য ল্যারি পেজ। সের্গেই ব্রিন এবং তিনি এই প্রযুক্তি জায়ান্টের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত শেয়ারহোল্ডার হিসেবে রয়ে গেছেন।

৯. মুকেশ আম্বানি (ভারত)

মোট সম্পদ : ১১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

তালিকায় ৯ম স্থানে থাকা ভারতের মুকেশ আম্বানি এই শত বিলিয়নিয়ারের একমাত্র এশীয় প্রতিনিধি বলা যায়। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে আম্বানির সম্পদ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কোম্পানিটি পেট্রোকেমিক্যাল, তেল ও গ্যাস, টেলিযোগাযোগ, রিটেল এবং আর্থিক পরিষেবাগুলোয় বিনিয়োগ করেছে।

৮. স্টিভ বলমার (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

ডট-কম সংকটের পর মাইক্রোসফটের সাবেক সিইও স্টিভ বলমার ২০০০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ডট-কম সংকট হলো নব্বই দশকের শেষে প্রযুক্তির স্টক হঠাৎ বাড়তে শুরু করে, তখন অনেকে তাতে বিনিয়োগ করে। পরে এই স্টক হঠাৎ পড়েও যায়। যার প্রভাবে অনেক ডট-কম স্টার্টআপ কোম্পানি তাদের ব্যবসার মূলধন খুইয়ে ফেলে। অনেকেই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যায়। স্টিভ বলমার সফলভাবে মাইক্রোসফট পরিচালনা করেছেন।

মাইক্রোসফট থেকে অবসর নেওয়ার পর, বলমার এনবিএ (ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন) এর লস অ্যাঞ্জেলেস ক্লিপার্স বাস্কেটবল দল কিনে নিয়েছিলেন, যার মান সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শুধুই বেড়েছে। আজ এটি এনবিএর পঞ্চম সব চেয়ে মূল্যবান দল।

৭. বিল গেটস (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই ২৩ বছর সময়ের মধ্যে ১৮ বার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জায়গা দখল করেছিলেন। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, ফোর্বস অনুসারে, প্রযুক্তি খাতে কঠিন প্রতিযোগিতা, সেই সাথে ২০২১ সালে এক ব্যয়বহুল বিবাহবিচ্ছেদ এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানে তার অনুদানের কারণে গেটস তার তালিকা থেকে নেমে গিয়েছেন।

৬. ওয়ারেন বাফেট (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

ওয়ারেন বাফেট বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচিত। তিনি মূলত বার্কশায়ার হ্যাথওয়ে নামে একটি একটি সমন্বিত ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। যার অধীনে বেশ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। যেমন বীমাকারী প্রতিষ্ঠান গেইকো, ব্যাটারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ডিউরাসেল এবং রেস্টুরেন্ট চেইন ডেইরি কুইন ইত্যাদি। বার্কশায়ারের শেয়ার রেকর্ড হারে গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।

৫. ল্যারি এলিসন (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ: ১৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

গত বছর, প্রযুক্তি কোম্পানি ওরাকলের শেয়ার ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে, যা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। ল্যারি এলিসন কোম্পানির সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তিনি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট পদে রয়ে গেছেন। সেই সাথে তিনি এই কোম্পানির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা এবং এর সব চেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার।

৪. মার্ক জুকারবার্গ (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

মেটার নির্বাহী পরিচালকের জন্য গেল বছর বেশ সংকটপূর্ণ ও জটিল ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই জায়ান্টের শেয়ারের মূল্য ২০২১ সালে তার সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে এক লাফে ৭৫ শতাংশ পড়ে যায়। তা সত্ত্বেও গত বছরে আবার এই শেয়ারের মূল্য প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।

৩. জেফ বেজোস (যুক্তরাষ্ট্র)

মোট সম্পদ : ১৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

অ্যামাজনের স্টক মার্কেটের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য বিদায়ী বছরে বেজোস আরও ধনী হয়েছেন।

২. ইলন মাস্ক (যুক্তরাষ্ট্র)

ইলন মাস্ক
ইলন মাস্ক। ছবি ক্রেডিট : উইকিমিডিয়া কমনস

মোট সম্পদ : ১৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

ইলন মাস্ক বেশ কয়েকবার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী খেতাব জিতেছেন এবং বেশ কয়েকবার শীর্ষ স্থান থেকে ছিটকে পড়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনীর এই র‍্যাঙ্কিংয়ে তার অবস্থান ক্রমাগত পরিবর্তিত হওয়ার কারণ হল তার স্পেসএক্স, টেসলা এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এক্স (আগের টুইটার) প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।

১. বার্নার্ড আর্নল্ট (ফ্রান্স)

মোট সম্পদ : ২৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে তালিকায় নিজের নাম তুলেছেন বার্নার্ড আর্নল্ট। আর্নল্টের সম্পদ ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। তার বিলাসবহুল সমন্বিত ব্যবসা এলভিএমএইচ-এর কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। তিনি একাধারে লুই ভিটন, ক্রিশ্চিয়ান ডিওর এবং সেফোরার মালিক। সম্পদ অর্জনে বছর শেষে আরেকটি রেকর্ড গড়ায় এলভিএমএইচ-কে ধন্যবাদ দেওয়াই যায়।

লেখা : বিবিসি অবলম্বনে

Muktojanala

সমসাময়িক সকল বিষয়ের মুক্ত তথ্যের অনলাইন প্লাটফর্ম।

https://www.muktojanala.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *