
ইমদাদুল হক জুয়েল
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের পসরা সাজিয়ে বসেছে সৌদি আরব। খেলাধুলা থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণের মতো বিলাসবহুল খাতে বিনিয়োগ করে সৌদি বিশ্বে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জানান দিতে চাইছে। মূলত তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সৌদি মেগাপ্রকল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু এসব বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা বৈশ্বিক বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে কতটা কার্যকর? আর এর আড়ালে তাদের মতলবটা-ই-বা কী?
সৌদি আরবের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি তেল। বিশ্বব্যাপী তেল রপ্তানি করে সৌদি তার অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। এছাড়া নারী অধিকার লঙ্ঘন, সমকামিতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ, মৃত্যুদণ্ডের বিধান, সাংবাদিক জামাল খাশোগজীকে হত্যা এবং ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ইন্ধন- ইত্যাদি নানা কারণে সৌদি আরব ব্যাপকভাবে বিতর্কিত এবং সমালোচিত।
তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে সৌদি যুবরাজ ও কার্যত (ডি-ফ্যাক্টো) শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ২০১৬ সালে তার ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেন। সৌদির শাসক অ-তেল শিল্পে বিনিয়োগের জন্য প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল সার্বভৌম-সম্পদ তহবিল (এসডব্লিউএফ) গঠন করতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর শেয়ার বিক্রির কথা জানান। এই বিনিয়োগ তহবিলের তিনি হবেন চেয়ারম্যান, পৃষ্ঠপোষক এবং পরিকল্পনাকারী। কথাটি একটু অন্যরকম শোনালেও সৌদি আরবের মতো গুপ্ত স্বৈরাচারী দেশে এটি ছিল মাথা ব্যথার মতো বিষয়। সৌদি যুবরাজের ভিশন-২০৩০ ঘোষণার পর বদলে যেতে শুরু করে সৌদির পরিবেশ। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হিসেবে দেখা যায়, সৌদির ক্যাফেতে মেয়েরা হিজাব ছাড়াই খোলাখুলি ছেলেদের সাথে হাসিঠাট্টা করছে। সৌদির আইনের বাইরে গিয়ে ওই সময় এমন ঘটনা ছিল দৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো বিষয়।

সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি, ভিশন-২০৩০ এর লক্ষ্য হচ্ছে সৌদি আরবের মানুষকে শারীরিকভাবে আরও সক্রিয় করা, পর্যটন বাড়ানো এবং অর্থনীতির বহুমুখীকরণ, যাতে করে জ্বালানি-তেল পরবর্তী বিশ্বের জন্য দেশকে প্রস্তুত করা।
এখনকার সৌদি এসডব্লিউএফ, যাকে দেশটির সরকার বিনিয়োগ তহবিল বা পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) বলা হয় তা যুবরাজ মুহাম্মদের স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। এর সম্পদের মূল্য ৭০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, এতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বেশি কর্মী রয়েছে এবং এটি বিশ্বব্যাপী এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, ওই ক্যাফেতে বসে ফ্লার্ট করা তরুণ-তরুণীদের মতোই। গলফ খেলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন, ইউরোপ থেকে নামিদামি ফুটবলারদের কিনে আনা, ভিডিও-গেমিং কোম্পানির উপর বেটিং করা, শূন্য থেকে একটি এয়ারলাইন গড়া বা আস্টন মার্টিনকে ইলেকট্রিক করা, যাই করা হোক না কেন পিআইএফ এখন বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারেনি। অর্থনীতিবিদ রবার্ট মোগিলনিকি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-তে অবস্থিত আরব গাল্ফ স্টেটস ইনস্টিটিউটে বলেছেন, সময় এসেছে সবকিছু দেখে শুনে বুঝে তারপর বিনিয়োগ করার। এটি যতটা চটকদার শোনায় বাস্তবে ততটা নাও হতে পারে। মনোযোগ সহকারে দেখুন, এর বিনিয়োগ পদ্ধতিতে তরুণ-তরুণীদের ফ্লার্ট করার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে।
এটি পিআইএফের শর্ত দিয়ে শুরু হয়। অনেক এসডব্লিউএফের মতো, দেশের তেল সম্পদকে বৈশ্বিক সম্পদে পরিণত করার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এতে রয়েছে। যাতে করে তেলের চাহিদা কমে গেলে ঘরে বসে বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। এটি ২০২৫ সালের মধ্যে এর ব্যবস্থাপনার অধীনে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ সংগ্রহ করতে চায় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ করতে চায়, যা একে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এসডব্লিএফে পরণত করবে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এই প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগই বিনিয়োগের রিটার্ন থেকে আসবে, কারণ এর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদ সৌদি আরবে রয়েছে। এছাড়া আরও অধিক বিনিয়োগের জন্য গত এপ্রিলে আরামকোর ৪% শেয়ার বিক্রি করে ৮০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। সৌদির হাতে বিনিয়োগের জন্য কত টাকা পাবে তা নির্ভর করে তেলের দামের ওপর, যা গত বছর বেশ ওঠানামা করেছে।

এটি কেবল তেলের উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থনীতিবিদ মোগিলনিকি উল্লেখ করেছেন, পিআইএফ-এর সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে যদি এটি তার সৌদি প্রকল্পগুলিতে সহ-বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। সেখানেই এর অভ্যন্তরীণ কৌশল তার বিদেশি কৌশলের সাথে জড়িত। এটি চারটি সৌদি ক্রীড়া দলের ৭৫% অংশীদারিত্ব নিয়েছে, যা বেসরকারিকরণ করা হলে তাদের মূল্য বৃদ্ধি করে আরও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, সময়ের সাথে সাথে, সহ-বিনিয়োগ তার কিছু শিল্প ও পর্যটন মেগাপ্রকল্পের মূল্যও বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন নিওম, যেটিকে পিআইএফ একটি মরু-নগর ইউটোপিয়াতে পরিণত করার লক্ষ্যে রয়েছে। পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এখানে আরও বেশি ধনী ও সম্পদশালী পর্যটককে আকর্ষণ করাতে হবে যার জন্য পুরো সৌদি আরবকেই পরিকল্পনার আওতায়া নিয়ে আসতে হবে।
এই পরিকল্পনায় সৌদি সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো বিনিয়োগ করেছে খেলাধুলায়। সৌদি গলফ লিগ এখন বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত নাম। এর আগে, দেশের ফুটবল লিগকে সমৃদ্ধ করতে ইংলিশ লিগের ক্লাব নিউক্যাসলের মালিকানা কিনে নেয়। এছাড়া পর্তুগিজ তারকা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর প্রায় ২০০ মিলিয়ন বেতনে সৌদি ক্লাব আল-নাসেরে যোগদান- সবই এই পরিকল্পনার অংশ। তাই ২০৩০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হতে সৌদি যদি এই প্রভাবশালী খেলোয়াডদের ব্যবহার করে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এ ধরনের বিনিয়োগ স্পোর্টসওয়াশিং হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এর ফলে ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের সৌদি বংশোদ্ভূত কলামিস্ট জামাল খাশোগির হত্যার মতো ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আড়ালে ঢেকে দিতে চাইছে। এ ধরনের ভাবমূর্তি তৈরি করার পেছনে যুক্তিও আছে। কাতার যেমন গত বছর ফুটবল বিশ্বকাপের মতো বড় ইভেন্টে আয়োজন করে তাদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছে। খেলাধুলার খরচ তুলনামূলক কম কিন্তু এটি বিশ্ববাজারের মনোযোগে বড় ধাক্কা দেয়।

পিআইএফ অন্যান্য কৌশলগত বিনিয়োগও করছে যা বাইরের বিশ্বে কম আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে, তবে এর অভ্যন্তরীণ প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গেমিং ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ। সম্পদের সংগ্রহে বৈচিত্র্য আনার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে পিআইএফ জাপানি গেমিং কোম্পানি নিন্টেন্ডোর সবচেয়ে বড় বিদেশি শেয়ারহোল্ডার হয়ে ওঠে। এটি নিওমকে একটি গেমিং-ডেভেলপমেন্ট হাবে পরিণত করার আশা করছে। ডিকার্বনাইজেশনের জন্য এর বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগগুলির একটি হলো ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লুসিডে বিনিয়োগ। গত ২৬ জুন লুসিড একটি ব্রিটিশ বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টন মার্টিনের সাথে বৈদ্যুতিক মোটর এবং ব্যাটারি সিস্টেম সরবরাহ করার জন্য একটি চুক্তি করেছে, যেখানে পিআইএফও এর বড় শেয়ারহোল্ডার। আশ্চর্যের বিষয় হলো- লুসিড সৌদি আরবে তার প্রথম বিদেশি কারখানাও তৈরি করছে।
পিআইএফের এ ধরনের বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো খাতে বিনিয়োগ বাস্তবতার বিপরীতে নতুন করে স্বপ্ন দেখায়। যদিও এ ধরনের বড় বাজি ধরা তুলনামূলক কম কাজে আসছে। লুসিডের মতো আরও কয়েকটি বিনিয়োগ হলো- সফটব্যাঙ্কের ভিশন ফান্ডের মাধ্যমে ভেঞ্চার-ক্যাপিটাল বিনিয়োগ এবং বিশ্বখ্যাত রাইড শেয়ারি অ্যাপ উবারে বিনিয়োগ। কিন্তু এক্ষেত্রে এরকম বিনিয়োগের রেকর্ডও খুব একটা ভালো নয়। যেমন গত মার্চে সুইস ব্যাংক ক্রেডিট সুইসে অসময়ে বিনিয়োগের জন্য সৌদি ন্যাশনাল ব্যাংক বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সৌদির কাছে নিওমের মতো মেগাপ্রকল্পগুলি এতটাই মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে যে তারা এর জন্য ঝুঁকি নিতে ন্যূনতম দ্বিধা করছে না (নিওম ভূমিতে বসবাসকারী হাওয়াইটাট উপজাতির সাথে আচরণের বিষয়ে মানবাধিকারের তদন্তের অধীনে রয়েছে)। যা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ যাবে তা হলো রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এরকম চোখ ধাঁধানো কোনো আবাসিক শহর গড়ে নয়।
তবুও একটি বড় জিনিস যা পিআইএফের পক্ষে রয়েছে তা হলো এর উন্মুক্ততা। গ্লোবাল এসডব্লিউএফের প্রধান ডিয়েগো লোপেজের একটি তথ্য উপস্থাপন করে বলেছেন, কোনো সার্বভৌম তহবিল তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এতটা প্রকাশ্যে প্রচার করে না। এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপের জন্য যুবরাজ সালমান নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। লক্ষ্যে অবিচল থাকতে এটি পিআইএফকে বাড়তি চাপের মধ্য রাখে।
তথ্যসূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি