![বিশ্বকাপ](https://www.muktojanala.com/wp-content/uploads/2023/10/world-cup.jpg)
দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপের দামামা। আর মাত্র একদিন পরেই পর্দা উঠছে ক্রিকেট বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ের। আগামী ৫ অক্টোবর থেকে টানা ৪৫ দিনে ক্রিকেট উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে থাকবে বিশ্ব। ১০ দলের বিশ্বকাপে এরই মধ্যে সবাই সবার প্রিয় দলকে সাপোর্ট দিতে আয়োজনের কমতি রাখছে না। ফেভারিট দলগুলোর শক্তি ও দুর্বলতা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে এর বাইরে এবারের আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের এমন কিছু বিষয় আছে যা হয়তো অনেকের জানা নেই। সেরকম ৫টি দিক তুলে ধরছি আজকের আলোচনায়। খবর বিবিসির।
ভারতে এককভাবে প্রথম বিশ্বকাপ
৫০ ওভারের এই বিশ্বকাপ প্রতি ৪ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়। তবে মজার বিষয় এবারই প্রথম এককভাবে আসরটি আয়োজিত হচ্ছে ভারতে! শুনতে একটু খটকা লাগলেও লাগতে পারে। কারণ ভারতে তো এর আগেও বিশ্বকাপের আসর বসেছে, আর সেটাও একাধিকবার।
তবে বাস্তবতা হলো এই প্রথম পুরোপুরি এককভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করছে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত। এর আগে, ১৯৮৭ সালে প্রথমবার ভারত বিশ্বকাপ আয়োজকের তালিকায় নাম লেখায়, সেবার সঙ্গী ছিল পাকিস্তান। এরপর ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় এই উপমহাদেশের তিন দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায়। ২০১১ সালে প্রথমবার আয়োজকের খাতায় নাম লেখায় বাংলাদেশ, সেবারও তিন দেশ-বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা মিলে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো হোস্ট করে। আর এর একযুগ পরে ও বিশ্বকাপ শুরুর ৪৮ বছর পর এসে এককভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেল ভারত।
১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এই টুর্নামেন্টের ১৩তম আসর বসছে ভারতের মোট ১০টি স্টেডিয়ামে। তবে সব আলো কেড়ে নিয়েছে গুজরাটের আহমেদাবাদে অবস্থিত নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩২ হাজার। উদ্বোধন ও ফাইনালসহ মোট ৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে এখানে।
বিশ্বকাপকে টার্গেট করেই এটির সংস্কার করা হয়। নতুন করে ২০২১ সালে উদ্বোধনের পর এর আগের নাম সরদার বল্লভভাই প্যাটেল বদলে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামানুসারে রাখা হয়েছে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের এই মাঠ অনেকের কাছে মোতেরা স্টেডিয়াম হিসেবেও পরিচিত। এরচেয়ে বড় স্টেডিয়াম গোটা দুনিয়াতেই আছে আর মাত্র একটা। সেটা উত্তর কোরিয়ার রাংরাডো মে ডে স্টেডিয়াম। সেই মাঠের দর্শক ধারণক্ষমতা দেড়লাখ।
তবে মজার ব্যাপার হলো এই প্রথমবার বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের কোনো ভেন্যু নির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ বলা আছে যে দুটি সেমিফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স এবং মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। কিন্তু কোনটি যে কোথায় তা নিশ্চিত হতে অপেক্ষা করতে হবে বিশ্বকাপের সেরা চার দল চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত।
আইসিসির সূচি অনুযায়ী, ১৫ নভেম্বর প্রথম সেমিফাইনাল হবে মুম্বাইতে; যেখানে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা দলের মুখোমুখি হবে চতুর্থ দল। আর পরদিন দ্বিতীয় সেমিফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে কলকাতায়, যেখানে প্রতিপক্ষ টেবিলের দুই ও তিন নম্বর দল।
কিন্তু এখানে জুড়ে দেয়া হয়েছে অদ্ভুত এক শর্ত, ভারত যদি সেমিফাইনালে ওঠে তাহলে প্রতিপক্ষ যেই হোক ম্যাচটি মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে-তে অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান যদি সেমিফাইনালে যায় তবে তাদের ম্যাচ হবে কলকাতায়। আবার সেমিতে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলেও সে ম্যাচটি হোস্ট করবে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স স্টেডিয়াম।
১০ নতুন অধিনায়ক
বিশ্বকাপ ইতিহাসে আর কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। ১০ দল যখন তাদের প্রথম ম্যাচে টস করতে নামবে তখন প্রতিটি দলেই দেখা যাবে আগের বিশ্বকাপ থেকে ভিন্ন অধিনায়ক। ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপে যারা দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের কারোরই সুযোগ হচ্ছে না ২০২৩ বিশ্বকাপে এসে অন্তত প্রথম ম্যাচে দলের অধিনায়কত্ব করার।
১০ দলের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম নিউজিল্যান্ড। টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিতে এসেছেন কেন উইলিয়ামসন। কিন্তু দেশটির ক্রিকেট বোর্ড জানিয়েছে ইনজুরির জন্য প্রথম ম্যাচে মাঠে নামা হচ্ছে না তার। সে জায়গায় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান টম লাথাম। এছাড়া বাকি ৯ দলের হয়েই নতুন সব অধিনায়ককে দেখা যাবে।
৫ অক্টোবর বিশ্বকাপের পর্দা উঠছে নিউজিল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে। গতবার ইংলিশদের প্রথম শিরোপা এনে দেওয়া এয়্যুইন মরগান গিয়েছেন অবসরে, তার জায়গায় ইংল্যান্ডের নতুন অধিনায়ক এখন জস বাটলার। পরদিন বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি পাকিস্তান-নেদারল্যান্ডস।
২০১৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের আলোচিত অধিনায়ক ছিলেন সরফরাজ আহমেদ। কিন্তু ফর্মহীনতায় ২০২১ সাল থেকেই রঙিন পোশাকে আর মাঠে নামা হয়নি তার। সে জায়গায় দায়িত্ব নেন বাবর আজম। অন্যদিকে দুই আসর পর আবারও বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে নেদারল্যান্ডস। স্বাভাবিকভাবে তাদের অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসেরও প্রথম বিশ্বকাপ এটি।
৭ অক্টোবর শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। মাশরাফির পর যে টাইগারদের নেতৃত্বভার এখন সাকিবের কাঁধে। প্রতিপক্ষ আফগানিস্তানেও দেখা যাবে নতুন নেতৃত্ব। ২০১৯ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা গুলবাদন নাইব এবার দলেই জায়গা পাননি। আফগানদের নেতৃত্বে এখন হাশমতউল্লাহ শহিদি।
দিনের আরেক ম্যাচে মুখোমুখি দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কা। এ দুদলেও নতুন অধিনায়ককে দেখা যাবে টস করতে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ফাফ ডু প্লেসির জায়গায় এসেছে টেম্বা বাভুমা, আর শ্রীলঙ্কার ২০১৯ সালের অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নে এবার দলে থাকলেও অধিনায়কের জায়গা নিয়েছে দাসুন শানাকা।
৮ অক্টোবর বাকি দুই দল ভারত আর অস্ট্রেলিয়াও মাঠে নেমে যাবে। গতবার ভারতকে নেতৃত্ব দেয়া ভিরাট কোহলিকে এবার দেখা যাবে শুধুই ব্যাটসম্যান হিসেবে, অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন রোহিত শর্মা। আর অস্ট্রেলিয়ার ২০১৯ বিশ্বকাপের অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ এখন অবসরে। বিশ্বকাপে তার নতুন ভূমিকা ধারাভাষ্যকারের। হয়তো বর্তমান ক্যাপ্টেন প্যাট কামিন্স যখন টস করতে নামবেন সেটার ধারা বর্ণনা করবেন সাবেক ক্যাপ্টেন ফিঞ্চ।
এখানে একটু জানিয়ে রাখি অধিনায়ক হিসেবে টানা দুবার করে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড আছে কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড আর অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিংয়ের।
নতুন নিয়ম
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচের একটা ঘটনা বেশ নজর কাড়ে। বোলিংয়ের সময় নন স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা ব্যাটসম্যান ইশ সোধি আগেই বেরিয়ে গেলে পেসার হাসান মাহমুদ স্টাম্প ভেঙে দেন। আম্পায়ারও জানিয়ে দেন আউট। তবে পরে অধিনায়ক লিটন ও হাসান মিলে সোধিকে আবারও ফিরিয়ে আনেন। আইসিসি বেশ কিছুদিন হলোই এটাকে বৈধ রান আউট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আগে যেটিকে ব্যাটসম্যানের ‘আনফেয়ার’ আচরণ বলা হতো এবং বোলার এক্ষেত্রে আউট করলে তা স্পিরিট অফ ক্রিকেটের বিপক্ষে যায় কি-না সে নিয়েও বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। তবে এবারের বিশ্বকাপে হয়তো এমন দৃশ্য প্রথমবারের মতো দেখা যেতে পারে। আর স্বাগতিক ভারত বরাবরই এরকম আউটের পক্ষে কথা বলে এসেছে, যেটা ‘মানকাড’ আউট হিসেবে পরিচিত।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের একটা ঘটনাও আলোড়ন তোলে। যখন ফ্রি-হিটে বোল্ড হয়ে গেলেও দৌড়ে রান নেন ভিরাট কোহলি। প্রচুর তর্ক-বিতর্কের পর এ বছর সেটিকে নিয়মে অন্তুর্ভুক্ত করেছে আইসিসি। অর্থাৎ ফ্রি হিটের সময় যদি ব্যাটসম্যানের স্টাম্প ভেঙে যায় তবুও তিনি দৌড়ে রান নিতে পারবেন, যা অতিরিক্ত খাতায় যোগ হবে।
এছাড়া টি-টোয়েন্টির মতো ওয়ানডেতেও এবার ফিল্ডিং দলকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইসিসি। সাড়ে ৩ ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করতে হবে ৫০ ওভার বোলিং। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ১৪ ওভারের একটু বেশি। সেটাতে ব্যর্থ হলে বোলিংয়ের শেষদিকে অতিরিক্ত সময়ের জন্য মাঠে ফিল্ডার রাখার ক্ষেত্রে জরিমানা দিতে হবে তাদের। অর্থাৎ শেষ ১০ ওভারে ৫ জনের জায়গায় বাউন্ডারিতে ৪ জন ফিল্ডার রাখা যাবে। তবে নতুন নিয়মের ক্ষেত্রে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটা প্রতিবেদন নজর কাড়ে। যেখানে দাবি করা হয় আইসিসি বিশ্বকাপের পিচ ও বাউন্ডারির ব্যাপারে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।
যেহেতু ভারতে এ সময় শিশির একটা বড় ফ্যাক্টর হতে যাচ্ছে সেহেতু, উইকেটে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ঘাস রাখতে বলেছে আইসিসি, যাতে পেসাররা বাড়তি সুবিধা পায়-এমনটি বলা হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া সাধারণত ওয়ানডে ম্যাচের জন্য আইসিসি সর্বনিম্ন ৬৫ মিটার বাউন্ডারির নির্দেশনা দিলেও বিশ্বকাপের জন্য তারা বাউন্ডারি সীমানা সর্বনিম্ন ৭০ মিটার করার কথা বলছে বলে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার দাবি। মাঠে ব্যাট-বলের ভারসাম্য আনতেই এমন চিন্তা আইসিসির।
নতুন প্রযুক্তি
প্রতি বিশ্বকাপেই নিত্য নতুন প্রযুক্তি যোগ হয়। তবে এবার প্রথমবারের মতো দর্শকদের জন্য ভার্টিকাল বা লম্বালম্বি ভিডিও প্রডাকশন করতে যাচ্ছে আইসিসি। সংস্থাটি জানায়, শুধু ক্রিকেট নয় খেলার ইতিহাসেই এটি হবে প্রথম ঘটনা। মূলত যারা মোবাইল ফোনে খেলা দেখবেন তাদের কথা মাথায় রেখেই এ উদ্যোগ নিয়েছে আইসিসি ও সম্প্রচার সহযোগী ডিজনি স্টার। এর জন্য প্রতিটি ভেন্যুতে আলাদা করে ক্যামেরা সেট করা হয়েছে। এছাড়া ‘স্প্লিট স্ক্রিন’ বা একই সাথে মাঠের দুটি ঘটনা দেখার সুযোগ থাকছে। এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আগ দিয়ে একটা ব্লকচেইন পার্টনার ঘোষণা করেছে আইসিসি।
সংস্থাটি নিয়ার ফাউন্ডেশনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যাদের কাজ হবে বিশ্বজুড়ে দর্শকদের আরো কীভাবে খেলা দেখার সাথে যুক্ত করা যায় ও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা দেয়া যায় সেটা নিয়ে কাজ করা।
পুরস্কার
বিশ্বকাপ জয়ের পুরষ্কার হিসেবে কাঙ্ক্ষিত ট্রফির সাথে বড় অংকের অর্থও মেলে চ্যাম্পিয়নদের। তবে অঙ্কটা আর বাড়ায়নি আইসিসি, গতবারের মতো এবারও চ্যাম্পিয়নদের জন্য বরাদ্দ চার মিলিয়ন ইউএস ডলার। আর রানার্স আপ পাবে এর অর্ধেক, দুই মিলিয়ন। আসরের মোট প্রাইজমানি হল ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ইউএস ডলার।
সেমিফাইনালে ওঠা দুই দল পাবে ৮ লাখ ডলার করে। আর প্রথম পর্বে বাদ পড়া বাকি ছয় দলের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ইউএস ডলার করে। এর বাইরে ম্যাচ জয়ের পুরষ্কারও দেবে বিসিবি। প্রতিটি দল ম্যাচ জিতলেই পাবে ৪০ হাজার ডলার করে বাড়তি অর্থ।
লেখা : বিবিসি অবলম্বনে