
প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। দৈনন্দিন প্রায় সব কাজকর্মই দিন দিন প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উৎকর্ষতায় ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করবে প্রযুক্তি। আশীর্বাদ না অভিশাপ সেই বিতর্কের বাইরে প্রযুক্তির যেভাবে বিকাশ ঘটছে তাতে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন রোগ হলে আর ডাক্তারদের শরণাপন্ন হতে হবে না। প্রযুক্তিই রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখবে!
অনলাইনভিত্তিক গবেষণা পত্রিকা অর্কিডে ২০২১ সালে ইয়েল জিমলিচম্যানের একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়। ওই নিবন্ধে ২০৩০ সাল নাগাদ স্বাস্থ্যসেবা খাত কেমন হতে পারে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেকোনো দেশে ও যেকোনো কালে রোগীর নিরাপত্তা ও সেবার মানকে বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রেই একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসছে প্রযুক্তি। এছাড়া সেবার প্রাপ্যতা সব স্তরে নিশ্চিত করাটাও এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে।
এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে ডিজিটাল জগতে হওয়া বিপ্লবকে সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত আজকের দিনে যেমন আমূল বদলে গেছে, ঠিক সেভাবেই বদলে যাবে স্বাস্থ্য খাত। আগের চেয়ে কম জনবল দিয়েই ভবিষ্যতের দুনিয়ায় বিপুল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাবে। এজন্য অবশ্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রযুক্তিবান্ধব হতে হবে।
কিন্তু এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি আসলে কারা হবে? গবেষণা নিবন্ধটিতে বলা হয়, এখনকার টেকজায়ান্ট যারা আছে, সেই গুগল, মেটা, আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোই হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য খাতের মূল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। কিংবা জন্ম হতে পারে নতুন কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের।

কেমন হবে সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা? আগামী ১০ বছরে বিশ্ব হয়তো এমন এক স্বাস্থ্যসেবার দুনিয়ায় প্রবেশ করবে, যেখানে প্রথাগত হাসপাতালগুলো আর চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্র হিসেবে থাকবে না। এই কেন্দ্র চলে আসবে ঘরের ভেতর, নিদেনপক্ষে নিজ এলাকা বা পাড়ায়।
অগমেন্টেড রিয়্যালিটির এই জমানায় বসে সুদূর আমেরিকার কোনো চিকিৎসক হয়তো ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে অস্ত্রোপচার করবেন মিরপুরের কোনো রোগীর। মিরপুরের কোনো কমিউনিটি সেন্টারে সেই অস্ত্রোপচার হয়তো করবে কোনো মানব চিকিৎসক কিংবা কোনো রোবট।
তাহলে চিকিৎসকেরা কী করবেন? প্রযুক্তির বদৌলতে সৃষ্ট এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার পুরোটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে স্বাস্থ্য খাত হয়ে উঠবে আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যনির্ভর।
চিকিৎসার জন্য লেনদেনের পদ্ধতি থেকে শুরু করে সবকিছুই যাবে বদলে। এরই মধ্যে আমাজন এর একটি নমুনা দেখিয়েছে। টেলিমেডিসিনকে গুরুত্ব দিয়ে এরই মধ্যে পুরো ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে উদ্যোগ নিয়েছে ব্রিটেনের এনএইচএস।
টেলিমেডিসিন বলতে অবশ্য এই দেশে এখন আমরা যা বুঝি, এনএইচএস বা আমাজনের নেওয়া উদ্যোগে তার ধরনটি একেবারেই আলাদা।
আমাজন আজ থেকে অন্তত তিন বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে একটি অ্যাপ চালু করেছিল তার কর্মীদের জন্য। সেই অ্যাপের মাধ্যমে আমাজনকর্মীরা বেশ কিছু স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারত। সফল হলে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা। সে সময়ই এনএইচএস আমাজনের সাথে আলোচনায় বসেছিল এ ধরনের একটি ব্যবস্থা ব্রিটেনের জন্য গড়ে তোলার জন্য। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে চিকিৎসকের পরামর্শ বিষয়টি অনায়াসে প্রযুক্তির মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে আজকের চিকিৎসকদের কী হবে? হ্যাঁ, তাদের নিজেদের বদল করতে হবে। তাদের হয়ে উঠতে হবে শুধু চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

রক্ত-মাংসের এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তখন রোগ সম্পর্কিত পূর্বানুমান, দীর্ঘস্থায়ী অসুখের নব সমাধান, নতুন সব গবেষণা, রোগ প্রতিরোধের নতুন সব উপায় উদ্ভাবনে বেশি নিযুক্ত হবেন।
হাসপাতালে বসে চিকিৎসা সেবা দেওয়া বা রোগীর যত্ন নেওয়ার কাজগুলো তখন কেরানির কাজে পরিণত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জিমলিচম্যানের গবেষণা নিবন্ধটিতে।
সেখানে রেডিওথেরাপি, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব ইত্যাদির উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, আগামীতে এই প্রতিটি খাতই চলে যাবে এআইয়ের হাতে। মানুষ কর্মী সেখানে থাকলেও তা কমে আসবে উল্লেখযোগ্য হারে। এরই মধ্যে অ্যাপল, গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রযুক্তি ও সেবা-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করছে।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যের এক বিরাট ভাণ্ডার নিয়ে ২০০৮ সালে যাত্রা করে ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া গুগল হেলথ কিন্তু ২০১৮ সালে আবার চালু হয়েছিল। অবশ্য ২০২১ সালে তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এই দ্বিতীয় জনমে গুগল হেলথ ফিটবিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কিনে নেয়। কিন্তু তারপরই পড়ে যুক্তরাজ্য ও ইইউয়ের আপত্তির মুখে। এত বিপুল পরিমাণে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথ্য গুগলের হাতে দিতে তারা রাজি ছিল না। ফলে দ্বিতীয় জন্মের পর এ উদ্যোগের বয়স বাড়েনি তেমন। তার এই দ্বিতীয় জন্ম ও মৃত্যুই বলে দিচ্ছে এ ধরনের উদ্যোগের তৃতীয় জন্মের মুহূর্তটি খুব বেশি দূরে নয়।
আমাজনের কথা আগেই বলা হয়েছে। তালিকায় আছে অন্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও। আপাতত বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো এ ধরনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাকে মেনে নিতে প্রস্তুত না হলেও মানুষের চাহিদা ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে একটি চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপের কাছে খুব শিগগিরই না হলেও বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থা এক সময় নতি স্বীকার করবে বলেই মনে হচ্ছে।
এই সময়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হচ্ছে এআই এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। স্বাস্থ্যসেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে এআই ব্যবহার করে ব্যক্তির কাছ থেকে কম তথ্য নিয়েই তুলনামূলক দ্রুত গতিতে ও নিপুনভাবে স্বাস্থ্য সমস্যা শনাক্ত করতে পারছে।
উদাহরণ হিসেবে গুগলের এআই ইউনিট ডিপমাইন্ডের একটি অ্যালগরিদমের কথা বলা যায়, যা চিকিৎসকদের চেয়েও নির্ভুলভাবে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করতে পারে।

এআইয়ের এই সম্ভাবনা অবশ্য কোভিডকালেই উন্মোচিত হয়েছে। সে সময় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কনটাক্ট ট্রেসিং, স্ক্রিনিং থেকে শুরু করে অনেক ধরনের কাজ এআই দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামের সরবরাহ, প্রয়োজনীয় ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার মতো বিষয়গুলোও অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এআইয়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
রয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যা সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে কম সময়ে দক্ষ ও নির্ভুলভাবে তথ্য প্রক্রিয়া করতে পারে। এতে বিভিন্ন ওষুধ ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দ্রুততম সময়ে নতুন নতুন গবেষণা ও এর ফল হিসেবে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন সম্ভব হবে।
এমনকি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উন্নতির ফলে একদিন চিকিৎসকের পরামর্শ পর্যন্ত এর পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ, রক্ত-মাংসের চিকিৎসকের প্রয়োজনও আর না পড়তে পারে।
এত দূর যেতে হবে কেন? হাতে হাতে থাকা স্মার্টফোনের মাধ্যমেই এখন রক্তচাপ, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, হার্টবিট ইত্যাদি মাপা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত গুগল প্লেতে হাজির হচ্ছে নতুন নতুন অ্যাপ, যা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য রুটিন কাজ করিয়ে নিতে পারছে ব্যবহারকারীদের।
আর গবেষণা ক্ষেত্রের কথা ধরলে এই অগ্রগতি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। ধরা যাক বায়োবটের কথাই।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়োবট নামের এই বায়োপ্রিন্টার দিয়ে মানুষের শরীরে থাকা টিস্যু, হাড়, এমনকি কানের মতো জটিল অঙ্গও প্রিন্ট করা যাবে। এই থ্রিডি প্রিন্টারকে বলা হচ্ছে যেকোনো স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি ডিভাইস।
এর মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট প্রত্যঙ্গ থ্রিডি প্রিন্ট করে সেখানেই চালানো যাবে গবেষণাধীন কোনো ওষুধ বা টিকার ট্রায়াল। এ জন্য আর সত্যিকারের মানুষদের স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার জন্য আহ্বান করার প্রয়োজন পড়বে না। পড়তে হবে না আইনি জটিলতায়ও।
এমন বায়োপ্রিন্টার তৈরি করেছে ফিলাডেলফিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এনভিশনটেক। শুধু এটি নয়, থ্রিডি প্রিন্টার নির্মাতা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এ নিয়ে কাজ করছে এখন।
এ তো গেল একটি দিক। দাঁতের চিকিৎসার মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসার কিছু অংশও এখন প্রযুক্তির আওতায়। স্মাইল ডিরেক্ট ক্লাব নামের এক মার্কিন প্রতিষ্ঠান দাঁত সাদা করা, সোজা করার মতো সেবা দিচ্ছে থ্রিডি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। আর রোবট নার্স তো উন্নত দেশগুলোতে এখন বাস্তবতাই।
ফলে চেনা স্বাস্থ্য খাত আর আগের মতো থাকবে না-এমনটা জোর দিয়েই বলা যায়। বাংলাদেশ সে জন্য কতটা প্রস্তুত হতে পারে, তাই এখন দেখার বিষয়।