মানুষ মাত্রই মরণশীল। কিন্তু এ মানবসভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এ কথাটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। যুগ যুগ ধরে বহু তন্ত্র-মন্ত্র সাধনা-আরাধনা চলেছে মৃত্যুকে জয় করার। এ যুগের অত্যাধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও খুঁজছে মৃত্যুকে কীভাবে ঠেকানো যায়। একদল বিজ্ঞানী এখন দিনরাত ঘাম ঝরাচ্ছেন অমরত্বের খোঁজে। যদিও কোনো কালেই সেই অমরত্বের সন্ধান মানুষ পায়নি, তবে এর জন্য ঘটিয়েছে অদ্ভুত সব কীর্তিকলাপ।

গল্প-উপন্যাস কিংবা সিনেমা-নাটকে আমরা অমরত্ব লাভের আশায় অনেক কল্পকাহিনী দেখে থাকি। কিন্তু যুগে যুগে বাস্তবে এমন সব অদ্ভুত ঘটনা আছে যা সিনেমা-নাটককেও হার মানাবে। কেউ কথিত জাদুর দ্বীপের অমৃত পান করেছেন, কেউ তরল সোনা, আবার কেউ স্বয়ং মানুষের রক্ত পান করেছেন অমরত্ব লাভের আশায়। রয়েছে গা শিউরে ওঠার মতো আরও বহু ঘটনা। আবার অনেকে রূপ-যৌবন ধরে রাখতে কুমারী মেয়েদের রক্তে গোসল করতেন নিয়মিত। সেসময়কার কোনো চেষ্টাই মানুষকে অমরত্বের খোঁজ দিতে পারেনি। তবে আধুনিক বিজ্ঞানে এই অমরত্বের সন্ধানে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে এসব গবেষণার পেছনে।

man carrying baby drawing their foreheads
Photo by Josh Willink on Pexels.com

অমরত্বের জন্য কত না লড়াই, কত না প্রতিযোগিতার দেখা মিলবে ভারতীয় পুরাণের দিকে তাকালে। ধরা যাক সেই সমুদ্রমন্থনের কথাই, যেখানে সবার শেষে দেবতাদের হাতে এসেছিল অমৃত। এই অমৃত কী? পুরাণমতে, অমৃত হচ্ছে সেই আরাধ্য, যা দেবতাদের দিয়েছে অমরত্বের স্বাদ।

গ্রিক পুরাণেও রয়েছে এমন এক জাদুকরী, যার নাম অ্যাম্ব্রোসিয়া। অমৃত বা অমীয় বা অ্যাম্ব্রোসিয়া, নাম যাই হোক, কাজ একই— দেবতাদের মতো মানুষকে তার আরাধ্য অমৃতের স্বাদ দেওয়া।

স্বর্গের সিঁড়ি তৈরির কত চেষ্টার গল্প আছে পৃথিবীতে। কেন স্বর্গ? সেও এক অমরত্বের খোঁজ। কারণ, সব ধর্ম ও পুরাণমতেই স্বর্গ হচ্ছে সেই স্থান যা অনন্তযৌবনা, যেখানে নেই কোনো জরা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ–নেই মৃত্যু। ফলে পৃথিবীজুড়েই মানুষ এখনো সেই স্বর্গে যাওয়ার পথই খুঁজছে।

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ধর্মই দেয় স্বর্গের প্রতিশ্রুতি। এজন্য সৎ পথ, সৎ চিন্তা ও সৎ কর্মের মতো কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।

সে যাক। ইতিহাসে ফেরা যাক। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে চীনের সম্রাট ছিলেন কিন শি হুয়াং। অন্য অনেক রাজা–মহারাজার মতোই তাঁরও সাধ ছিল অমর হওয়ার। গিলগামেশের মতোই তিনি ছিলেন মৃত্যুচিন্তায় ভীষণভাবে ভীত। এটা এতটাই যে, মৃত্যু নিয়ে যেকোনো আলোচনাকেই তিনি বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন। এর জন্য শাস্তির বিধানও করেছিলেন। কী সেই শাস্তি? অবশ্যই মৃত্যু।

Mortals and Immortals

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো স্টিফেন কেভের ‘ইমমর্টালিটি’ বইয়ে মানুষের অমরত্বের পেছনে ছোটার এমন অজস্র কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছেন, কিন শি হুয়াং মৃত্যু নিয়ে এমন অবস্থান নিলেও তাঁর রাজ্যে ঠিকই মৃত্যু নিয়ে গ্রাফিতি করেছিল কেউ। তিনি তখন তাঁর সেনাবাহিনীকে আদেশ দেন, সেই ব্যক্তিকে ধরে আনতে, যেমনটা করেন আরকি সম্রাটেরা। কিন্তু সেনাদল ব্যর্থ হয়। পরে ওই এলাকার সব মানুষকে সম্রাটের আদেশে হত্যা করা হয়। হায় অমরত্বের পিছে ধাওয়া এক সম্রাটের খেয়ালে মারা পড়তে হয়েছিল কত না মানুষকে।

এই সম্রাটও কিন্তু পেয়েছিলেন অমৃতের খোঁজ। এ খোঁজ তাঁকে দিয়েছিলেন এক জাদুকর; নাম জু ফু। জু ফু সম্রাটকে জানান, পূর্ব চীন সাগরে এক জাদুর দ্বীপে রয়েছে সেই অমৃত। সেই অমৃত নিয়ে আসতে যথেচ্ছ অর্থায়ন করেন সম্রাট। আজকের শতকোটিপতিদের মতোই। শেষ পর্যন্ত তাঁকে এক অদ্ভুত পানীয় দেওয়া হয়। আর সম্রাট কিন পারদের বিষক্রিয়ায় মাত্র ৪৯ বছরেই মারা যান।

যুগে যুগে এমন অজস্র অমৃতের সন্ধান মানুষ পেয়েছে। বেশি নয়, এই গত ষোড়শ শতকে এক ফরাসি নারীর ইচ্ছা হলো তিনি চীরযৌবনা থাকবেন। দায়াঁ দ্য পতিয়েঁ নামের সেই নারী শারীরিক সৌন্দয্য রক্ষায় পান করেছিলেন তরল সোনা।

অবশ্য চিরযৌবনের জন্য ইতিহাসে বহু মানুষকেই পাওয়া যাবে, যারা সোনাকে বেছে নিয়েছিলেন নিদান হিসেবে। কারণও আছে। সোনা সেই বহু আগে থেকেই অভিজাত ধাতু হিসেবে সমাদৃত। ফলে মানুষ অর্থবিত্তের লোভে শুধু নয়, চীরযৌবনের লোভেও সোনার খোঁজ করেছে। আর এই খোঁজ তাকে নিয়ে গেছে পরশপাথর খোঁজার পথেও। কী সেই পরশপাথর? এ হলো সেই পাথর বা বস্তু, যার স্পর্শে এলে সবই সোনা হয়ে যায়।

অমৃত হোক বা চিরযৌবনের খোঁজেই হোক, মানুষ বারবার ফিরে গেছে রক্তের কাছে। রক্তকে মানুষ কখনো পবিত্র জ্ঞান করেছে, কখনো অচ্ছুত। এও এক লম্বা গল্প। সে গল্পকে পাশে রেখেই বলা যায় যে, শুধু অনন্ত যৌবন বা জীবনের জন্য যুগে যুগে অভিজাতরা কত কত মানুষই না মেরেছে, শুধু তাদের রক্তের জন্য।

১৪৯২ সালে মৃতপ্রায় পোপ অষ্টম ইনোসেন্টের শরীরে শিশুদের রক্ত প্রবেশ করানো হয়েছিল। হায় শিশু, হায় অমরত্ব!

woman in white long sleeve shirt standing near white and gray house during daytime
Photo by Julian Jagtenberg on Pexels.com

আর ১৭ শতকের হাঙ্গেরির কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরির গল্প কে না জানে। তিনি কুমারীদের রক্তে নিয়মিত স্নান করতেন, এর মাধ্যমে তাঁর শরীরের ত্বক সবসময় টানটান ও তারুণ্যদীপ্ত থাকবে।

আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা তো বলতেই হয়। বিশ শতকের সেই ভয়াবহ সময়ে নাৎসিরা নেমেছিল এই অমরত্বের খোঁজে। নাৎসি নেতা হেনরিখ হিমলার খ্রিষ্টীয় মতে অমৃতের গুণধারী হলি গ্রেইলের খোঁজে নামেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এই হলি গ্রেইল তাঁকে অতিমানবের শক্তি দেবে। কারণ, মধ্যযুগ পর্যন্ত এ কথা প্রচলিত ছিল হলি গ্রেইলে করে কিছু পান করলে, তা মৃত্যুকে বিনাশ করে।

হিমলার কখনোই সেই গ্রেইলের দেখা পাননি। অমরত্বও ধরা দেয়নি। ব্রিটিশ সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি শেষ পর্যন্ত সায়ানাইড পান করে মারা যান।

এমন অজস্র গাথা ও গল্প আছে, যা পুরাণ বা ইতিহাস ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। অমরত্ব এখনো ধরা দেয়নি মানুষের হাতে। তবে চেষ্টা থেমে নেই। বিজ্ঞানীরা আজও চেষ্টা করে যাচ্ছেন অমরত্বের খোঁজ পেতে। দেশে দেশে অ্যান্টি–এজিং নিয়ে গবেষণার বিস্তার হচ্ছে। কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ফল কী আসে, তা এখনো কেউ জানে না। তবে সবাই আশায় বুক বেঁধে আছে।

Muktojanala

সমসাময়িক সকল বিষয়ের মুক্ত তথ্যের অনলাইন প্লাটফর্ম।

https://www.muktojanala.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *