সারা দুনিয়ার যে কটি স্থানের বাসিন্দারা দীর্ঘ জীবন লাভ করে জায়গাটি তার মধ্যে অন্যতম। দ্বীপটির বেশিরভাগ মানুষই ১০০ বছর বা তারও বেশি সময় বাঁচে। বলা হয়ে থাকে, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস ও ফুরফুরে চিন্তামুক্ত জীবনযাপন ও জলবায়ু সেখারকার বাসিন্দাদের শতবর্ষী হওয়ার রহস্য। পাশাপাশি দৃঢ় সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন, নিয়মিত শরীর চর্চা এবং প্রয়োজন মাফিক ঘুম ইত্যাদি এই দ্বীপের বাসিন্দাদের যেন অমরত্বের সন্ধান দিয়েছে।

বলা হচ্ছে, এজিয়ান সাগরের পূর্ব অংশের গ্রিসের ছোট ইকারিয়া দ্বীপের কথা। যদিও ২৫৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত দ্বীপটিতে স্থায়ী বাসিন্দা মাত্র আট হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু গড় আয়ুর বিচারে এখানকার জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে অন্যতম। বিশ্বে যেসব অঞ্চলের মানুষ শতবর্ষী হওয়ার হার বেশি সেসব অঞ্চলকে ‘ব্লু জোন’ বলা হয়। আর এই ইকারিয়া বিশ্বের পাঁচ ব্লু জোনের একটি।

এখানে যেন মানুষের জীবনে এমন কিছু একটা ঘটেছে, যার ফলে ‘মৃত্যুকে ভুলতে বসেছেন তারা! বা অন্যভাবে বললে বিষয়টা এমন, অমরত্বের রহস্য জেনে ফেলেছেন! ১০০ বছরেও লাঠি-নির্ভর নন এখানকার বাসিন্দারা। পাহাড়ি সিঁড়ি ভেঙে একাই উঠে যান গির্জায়।

ভাবতে অবাক লাগলেও বয়স তাঁদের যৌবনেও ছাপ ফেলতে পারে না। তাই ৮০ শতাংশ ইকারিয়ান ৬৫ থেকে ১০০ বছরেও সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক যৌন জীবন পর্যন্ত উপভোগ করেন। ইউনিভার্সিটি অব আথেন্স-র এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস ও ফুরফুরে চিন্তামুক্ত জীবনযাপনই ইকারিয়ার বাসিন্দাদের শতবর্ষী হওয়ার রহস্য। ছবি ক্রেডিট : ফ্লিকার

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শতায়ুর সংখ্যা এই দ্বীপে কেন? কেন এখানে মানুষ কম অসুখে ভোগেন? বিশ্বে ভয়ানক হারে বাড়তে থাকা ক্যানসার এবং হৃদরোগ এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে দেখাই যায় না, সেটা কী ভাবে সম্ভব? প্রচুর গবেষণাও হয়েছে এ নিয়ে।

গবেষণায় বারবারই তাঁদের লাইফস্টাইলের বিষয়টি উঠে এসেছে। তাঁদের চিন্তামুক্ত জীবনযাত্রা, খাদ্যাভাস এবং সর্বোপরি এই দ্বীপের জলবায়ু— এই তিনটি কারণের জন্যই ‘মৃত্যুকে ভুলতে বসেছেন’ এঁরা, এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

দ্বীপটিতে অন্যান্য অনেক জায়গার তুলনায় ক্রনিক ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী রোগের হার কম। প্রকৃতপক্ষে, এক-তৃতীয়াংশ ইকারিয়ান ৯০ বছরের বেশি বেঁচে থাকেন।

মেডিটারেনিয়ান ডায়েট বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস স্বাস্থ্যকর হিসেবে সুপরিচিত। এই ডায়েটের সাথে মিল আছে ইকারিয়া ডায়েটের। এতেও স্বাস্থ্যকর চর্বি, প্রচুর আঁশ বা ফাইবার এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই খাদ্যাভ্যাস ব্যাপকভাবে উদ্ভিজ্জ নির্ভর। বাদাম, আলু, লেবু, শাকসবজি, শস্য এবং বীজে আধিক্য থাকে সেখানে। ফ্যাট বা চর্বির প্রধান উৎস হিসেবে থাকে জলপাই তেল। দই, পনির, মাছ, পোল্ট্রি এবং রেড ওয়াইন পরিমিত খাওয়া হয়। লাল মাংস খাওয়া হয় খুবই সীমিত পরিমাণে, মাসে কয়েকবার।

দেখা গেছে, এমন নিয়ম মেনে খাবার নির্বাচনে অনেক রোগের ঝুঁকি কমে যায়। হ্রাস পায় হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের নেপথ্য কারণগুলো।
ডায়ান কোচিলাস নামে একজন গ্রিক-আমেরিকান শেফ সম্প্রতি একটি রান্নার বই লিখেছেন। নাম – ‘দ্য ইকারিয়া ওয়ে’।

শেফ ডায়ান কোচিলাস তার এই নতুন বইয়ে দ্বীপটির বাসিন্দাদের খাবারের আলোকে একটি ‘প্ল্যান’ দিয়েছেন। যারা নিজেদের পাতে মেডিটারেনিয়ান ঘরানা নিয়ে আসতে চান তাদের জন্য এই পরামর্শ।

বইটি দুটি প্রশ্নে আলোকপাত করে : কীভাবে “মনকে কষ্ট না দিয়েও” শরীরকে ভাল রাখা যায় এবং রান্নাটা কীভাবে করতে হবে। প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি খুঁজেছেন প্রশান্তি ও স্বস্তিদায়িনী দ্বীপটির সরল ও মৃদুগতির জীবনের অনুপ্রেরণায়। যেখানে মানুষে মানুষে বন্ধন গড়ে ওঠে খাবার টেবিলকে ঘিরে।

নানা রকম খাবারের কথা বলা হয়েছে বইয়ে। এতে দই, শসা এবং আখরোট স্যুপের মতো হালকা খাবার, স্ন্যাকস, বড় বা মাঝারি লোকসমাগমের ডিনারের রেসিপি যেমন মিলবে তেমনি পাওয়া যাবে পনিরে ভাজা পিচ এবং আরগুলা সালাদ; রেড ওয়াইনে ভাজা মশলাদার মটরশুটি; পেস্তা-কিসমিসের পোলাওয়ের মত পদ।

ডায়ান কোচিলাস বলেন, ‘লোকে যে পরিমাণ চাপ নেয়, এটা আমাকে রীতিমত অবাক করে। আমেরিকাতে খুব দেখা যায়, স্ট্রেস নিয়ে লোকে নিজের ক্ষতি করে। বেশিরভাগ সময় আমাদের মাথার ভেতরেই কেবল এর অস্তিত্ব থাকে, চিন্তার ধরণের কারণে যা তীব্র হয়’।

তার বইয়ের লক্ষ্য, মানুষ যেন নিজের যত্ন সম্পর্কে আরও সচেতন হয়। কোচিলাস দেখাতে চান “খাবারও একটা ভালোবাসার নাম।”

কোচিলাসদের আদি নিবাস ইকারিয়াতেই। এখনো বছরের অর্ধেক সময় এখানে কাটে তার। রান্নার বই লেখার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম পিবিএস-এ ‘মাই গ্রিক টেবিলনামে’ রান্নার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। ইকারিয়াতে একটি রান্নার স্কুলও চালান কোচিলাস।

একশোটি প্ল্যান্ট-বেইজড বা উদ্ভিজ্জ উপাদানের রেসিপি নতুন রান্নার বইয়ে অন্তর্ভূক্ত করেছেন তিনি। রান্নার ক্লাস করাতে গিয়ে বইয়ে এগুলো ঢোকানোর কথা তার মাথায় আসে।

তিনি লিখেছেন, ‘মন্টানা থেকে দুজন অতিথি এসেছিলেন। ক্লাসের রান্নাঘরের কাউন্টারে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা। বলেছিল, তারা শুধু বাড়িতে দিনে তিনবার মাংস খায় তাই নয়, কখনো কল্পনাও করেনি যে, কেবল উদ্ভিদ-ভিত্তিক উপাদান দিয়েও এত রান্না করা যায়। সপ্তাহজুড়ে যা করি সেসব এমনই প্রাণবন্ত, তৃপ্তিদায়ক এবং বৈচিত্র্যময়’।

ইকারিয়ার নিরামিষ খাবারগুলোতে স্বাস্থ্যের উৎকর্ষ এবং মনের সন্তুষ্টি যেমন আসে, বাস্তবতার বিচারেও এগুলো তৈরি করা সুবিধাজনক।

গ্রিসের অন্যান্য অংশের মতো এই দ্বীপেও কিছু মানুষ এখনও গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের দিনপঞ্জি অনুযায়ী উপবাস ব্রত পালন করে থাকে। তাই, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় যেমন লেন্ট (ইস্টারের আগের ৪০ দিনের উপবাস) এর সময় মাংস খায় না।

গড় আয়ুর বিচারে ইকারিয়ার জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে অন্যতম। ছবি ক্রেডিট : উইকিমিডিয়া কমনস

কোচিলাসের রান্নার বইয়ে যেসব উপাদানের কথা বলা হয়েছে সেগুলো ইকারিয়াতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে দই, বাদাম, মধু, সামুদ্রিক লবণ, জলপাই তেল, বাদাম, টাটকা ভেষজ উপাদান, নানাবিধ শস্য, রসুন এবং বিভিন্ন ধরনের লেবু।

বিশ্বের যেকোন প্রান্তের সুপারমার্কেটেই এগুলোর কাছাকাছি পণ্য পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন মিজ কোচিলাস।
দ্য ইকারিয়া ওয়েতে শিমজাতীয় খাদ্যের জয়জয়কার। যত পদের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে, এগুলোকে কোচিলাস বিশেষ স্থান দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে দুয়েকটির কথা বলা যায় – মটরশুটি, তাহিনি(এক ধরনের তিল বাটা) এবং দই; ফাভা বিন(বিশেষ জাতের শিমের বিচি) স্টু; মরিচ দিয়ে কিডনি বিন; হলুদ, মৌরি এবং লেটুসসহ ক্যারামেলাইজড জাম্বো বিন।

কোচিলাস জানান, শিম বা মটরশুটি কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদযন্ত্রকে রাখে। কারণ এগুলো দ্রবণীয় ফাইবার সমৃদ্ধ, যা কোলেস্টেরলের কণিকার সাথে মিশে সেগুলোকে শরীর থেকে সরিয়ে নেয়। টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এটি উপশমকারী।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে “ইট বিনস্ অ্যান্ড লিভ লংগার (শিম/মটরশুটি বিচি খাও, দীর্ঘায়ু হও) ব্লু জোনের মত খাদ্যাভ্যাসের প্রবক্তাদের জন্য একটি মন্ত্র হয়ে উঠেছে।

কথাটি মূলত ড্যান বুয়েটনারের। তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন কর্মী এবং দীর্ঘায়ু বিশেষজ্ঞ। তার দাবি, “প্রতিদিন এক কাপ পরিমাণ ‘বিন একজন ব্যক্তির আয়ু চার বছর বাড়িয়ে দিতে পারে।”

কেউ চাইলে “যেকোন জায়গায়ই ভাল বিন পাবেন,” উল্লেখ করেছেন কোচিলাস। এটি স্যুপ, সালাদ বা প্রধান খাবারে বহুমুখী ব্যবহার করা যায় বলে বইটিতে এর তেমন বিভিন্ন রেসিপিও দিয়েছেন তিনি।

বেগুন, টমেটো, ‘ফেটা পনির (ভেড়া বা ছাগলের দুধ থেকে তৈরি গ্রিক পনির) দিয়ে হোয়াইট বিন স্টু রেসিপি সম্পর্কে কোচিলাস লিখেছেন “এই সাধারণ খাবারটি শাকসবজির সাথে ‘বিন এবং ডাল দিয়ে করা অনেক গ্রিক রান্নার একটি।”

বাড়িতে কেউ করতে চাইলে রেসিপিটির জন্য টিনজাত বিন ব্যবহার করতে পারেন। একটি পুষ্টিকর এবং সুষম খাবার পেয়ে যাবেন তারা।

দ্য ইকারিয়া ওয়েতে ডায়ান কোচিলাস বিভিন্ন গ্রিক আদবকেতার কথাও বলেছেন। তেমনই একটি ‘কালি অরেক্সি’। খাওয়ার সময় পরস্পরকে এটি বলার রেয়াজ প্রচলিত গ্রিক সমাজে। যার মানে “(খাবার) উপভোগ করুন!”
কেউ যখন ইকারিয়া ওয়েতে কোনো রেসিপি অনুসরণ করে খাবার বানাবেন, ওই বাক্যটিও হয়তো তাদের সম্ভাষণে ঠাঁই করে নেবে।

লেখা : বিবিসি ও আনন্দবাজার অবলম্বনে

Muktojanala

সমসাময়িক সকল বিষয়ের মুক্ত তথ্যের অনলাইন প্লাটফর্ম।

https://www.muktojanala.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *