হিরোশিমা ও নাগাসাকি জাপানের এই দুটি শহরের নাম শুনলেই আমাদের পড়ে পারমাণবিক বোমার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটে যাওয়া এ বিভীষিকা পৃথিবীর ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। আমেরিকা অতিগোপনীয় ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে পরমাণু বোমা দুটি বানিয়েছিল। কিন্তু এরপরই বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রেগুলোর মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এর এ দৌড়ে সর্বপ্রথম সফল হয় বিশ্বের আরেক পরাশক্তি রাশিয়া। মাত্র ৪ বছরের মাথায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করে তাদের প্রথম প্লুটোনিয়াম পরমাণু বোমা আরডিএস-ওয়ান। রাশিয়া ১৯৪৯ সালেই সফলভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে কিছুটা হতচকিতই করে দেয়। মজার ব্যাপার হলো আমেরিকার হাত থেকে পারমাণবিক বোমার প্রযুক্তি রাশিয়ার হাতে পৌঁছানোর পিছনে ছিলেন থিয়োডোর হল নামে যুক্তরাষ্ট্রেরই এক বিজ্ঞানী। তিনিই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক বোমার গোপন তথ্য পাচার করে দিতেন। খবর বিবিসির।

আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কোনো রকম আন্দাজই করতে পারেনি যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এত তাড়াতাড়ি পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলবে। তাদের ধারণা ছিল যে ১৯৫৩ সালের আগে হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন এই কাজে সফল হতে পারবে না।

থিয়েডার হল ছাড়া আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কে জন্ম হওয়া, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বিজ্ঞানী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কেন হাত মিলিয়েছিলেন, সেটা বড় রহস্য।

মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ১৯৯৭ সালে থিয়োডোর হল নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছিলেন যে তার ভয় ছিল যে পারমাণবিক অস্ত্রের ওপরে একাধিপত্য না কায়েম হয়ে যায়। তাই তিনি চেয়েছিলেন শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতেও পারমাণবিক অস্ত্র থাকা জরুরি ছিল।

“সোভিয়েত ইউনিয়ন বীরত্বের সঙ্গে নাৎসি হিটলারের বিরুদ্ধে লড়েছিল প্রচুর প্রাণের বিনিময়ে। সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নই নাৎসি জার্মানির দ্বারা পরাজয়ের হাত থেকে পশ্চিমা সহযোগীদের বাঁচিয়েছিল”- বলেছিলেন থিয়োডোর।

যুক্তরাষ্ট্র ৯ অগাস্ট, ১৯৪৫ সালে নাগাসাকির ওপরে যে পরমাণু বোমা ফেলেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম যে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল- দুটোই একই রকমের বোমা ছিল। সেটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। অতিগোপনীয় ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমা বানিয়েছিল। সেই প্রজেক্ট থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে ডিজাইনটি চলে যায়।

‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্য আর কানাডাও যুক্ত ছিল। পরমাণু অস্ত্র প্রকল্পের গোপনীয়তা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারাদেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ছাড়া আর কারও ধারণাই ছিল না যে ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এ কী করা হচ্ছে। থিয়োডোর হল ছিলেন ওই হাতে গোনা কয়েকজনের অন্যতম।

থিয়োডোর হলের জন্ম হয় ২০ অক্টোবর ১৯২৫ সালে, নিউইয়র্কের এক ব্যবসায়ী পরিবারে। তার মা ছিলেন গৃহবধূ। তার জন্ম হয়েছিল এমন একটা সময়ে, যা ইতিহাসে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত। তখন কঠিন জীবন-যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যেত হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষকে।

সেই দুরবস্থার মধ্যেও কিন্তু থিয়োডোর হলের গণিত আর ভৌত বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা আটকায়নি।

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই থিয়োডোর হল ভর্তি হয়েছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিনি স্নাতক হন ১৯৪৪ সালে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্নাতক স্তরের ফলাফল দেখেই থিয়োডোর হলের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের নজর পড়ে। তারা সেই সময়ে পরমাণু প্রকল্পের জন্য প্রতিভাবানদের খোঁজ চালানো হচ্ছিল।

বিজ্ঞানী থিয়োডোর হল । ছবি ক্রেডিট : বিবিসি

চাকরিতে নিয়োগের জন্য কর্মকর্তারা থিয়েডার হলের প্রথম ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন লস অ্যালামোস ল্যাবরেটরিতে। তবে তাদের জানা ছিল না যে আগেই থিয়োডোর হলের এক জায়গায় নিয়োগ হয়ে গেছে। তিনি মার্কসবাদী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিলেন আর হোস্টেলে তার রুমেই থাকতেন স্যাভিল স্যাক্স নামে আরেক ছাত্র। তিনি ছিলেন এক রুশ অভিবাসীর পুত্র।

স্যাভিল স্যাক্সের জন্ম নিউ ইয়র্কে হলেও তিনি ছিলেন একজন কমিউনিস্ট। তিনিই থিয়োডোর হলকে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য কাজ করতে রাজি করান এবং পারমাণবিক বোমা সম্বন্ধে সব গোপন তথ্য তার হাত দিয়েই পৌঁছে যায় মস্কোয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নে যাদের কাছে তিনি পারমাণবিক বোমার তথ্য পাঠাতেন, তারা থিয়োডোর হলকে দ্য ইয়ংস্টার বলে উল্লেখ করত। থিয়োডোর হলের বয়স তখন ছিল মাত্রই ১৯ বছর। যুক্তরাষ্ট্র নাগাসাকিতে যে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, সেটা ছিল প্লুটোনিয়াম বোমা এবং হিরোশিমায় ফেলা হয়েছিল ইউরেনিয়াম বোমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু দেশ ছিল একই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র আর মস্কো একে অন্যের ওপরে গোয়েন্দাগিরি চালাত না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচরবৃত্তির পাল্টা যুক্তরাষ্ট্র একটা প্রকল্প চালু করেছিল ১৯৪৩ সালে, যেটার নাম ছিল ভেনোনা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘কোড-ব্রেকার’রা ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গোপন বার্তাগুলি পড়ে ফেলতে শুরু করে। সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারে যে তাদের অতি গোপনীয় ‘ম্যানহাটান প্রোজেক্ট’-এও সোভিয়েত গুপ্তচর রয়েছে।

থিয়োডোর হল ১৯৫৯ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি আসলে মস্কোর সহযোগী। এফবিআই এজেন্টরা তার কাছে পৌঁছেও গিয়েছিলেন। এর এক বছর আগে ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এ কর্মরত এক ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক ক্লৌস ফুস এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ডেভিড গ্রিণগ্লাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু গবেষণার তথ্য শত্রু দেশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

তিন গুপ্তচরের এই চক্রে থিয়োডোর হলকে ‘দ্য থার্ড ম্যান’ বলেও চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু থিয়োডোর হল আর তার বন্ধু স্যাভিল স্যাক্সের কাছ থেকে কখনই জবানবন্দি আদায় করতে পারেনি এফবিআই। অন্য কোনও গুপ্তচরও যেমন কখনও থিয়োডোর হলের নাম নেননি, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরদেরও চোখে কখনও এমন কিছু পড়েনি যে থিয়েডার হল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গোপন তথ্য পাচার করছেন।

‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এর পরে থিয়োডোর হল দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে মস্কোয় পৌঁছানোর মতো প্রচুর যোগাযোগ ছিল, যা দিয়ে হলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আদালতে কখনও এটা বলতে চায়নি যে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন বার্তাগুলি পড়ে ফেলতে সক্ষম। এর ফলেই থিয়োডোর হল বেঁচে গিয়েছিলেন।

নিজের আর তার স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন থিয়োডোর হল। তাই যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি গ্রহণ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পরে তিনি নিরিবিলি অবসরজীবন যাপন করছিলেন। সেই সময়েই তার ইতিহাস প্রকাশ পেয়ে যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরণো নথিপত্র যখন ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়, তখনই মস্কোর সঙ্গে তার সম্পর্কে কথা সামনে আসে। ততদিনে স্যাভিল স্যাক্সসহ বাকি সাক্ষীদের মৃত্যু হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিককে থিয়োডোর হল বলেছিলেন,

“এরকম একটা অভিযোগ করা হয় যে আমি নাকি ইতিহাসের ধারাই বদলে দিয়েছিলাম। যদি ইতিহাসের সেই ধারা না বদলাতো তাহলে গত ৫০ বছরে হয়তো পারমাণবিক যুদ্ধ হয়ে যেত। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৯ বা ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে চীনের ওপরে হয়তো পারমানবিক বোমা ফেলা হয়ে যেত”- নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিককে থিয়োডোর হল বলেছিলেন।

“যদি আমি যদি এসব ঘটনা না ঘটতে দেওয়ার জন্য কোনওভাবে সাহায্য করে থাকি, তাহলে আমি এই অভিযোগ স্বীকার করছি,” বলেছিলেন থিয়োডোর হল।

নাগাসাকি ও হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলার সাত দশকেরও বেশি সময়ে যে পারমাণবিক অস্ত্র আর কখনও ব্যবহৃত হয়নি, তার পিছনে তার অবদান ছিল। এই বিশ্বাস নিয়েই ক্যান্সারে আক্রান্ত থিয়োডোর হল পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। তার মৃত্যুর খবর বিবিসিতে প্রকাশিত হয়েছিল বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে।

লেখা : বিবিসি অবলম্বনে

Muktojanala

সমসাময়িক সকল বিষয়ের মুক্ত তথ্যের অনলাইন প্লাটফর্ম।

https://www.muktojanala.com

1 comment on “আমেরিকার পারমাণবিক বোমার তথ্য যেভাবে পেয়েছিল রাশিয়া

  1. Hey there! This is my first comment here so I just wanted to give a quick shout out and tell you I genuinely enjoy reading your blog posts. Can you recommend any other blogs/websites/forums that cover the same subjects? Thank you!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *